মোঃ হুমায়ুন কবির মানিক :
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও নবীগঞ্জের দিনারপুর উচ্চ বিদ্যালয় এবং জগদীশপুর জে সি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক কাজী আজিজুর রহমানের ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৫ বছর বয়সে ২০১৬ সালের এই দিনে তিনি নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। অজপাড়া গাঁয়ের এক হতদরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়েও নিজ কর্মগুণে ৭৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে সাফল্যের শিখরে উঠেছিলেন কাজী আজিজুর রহমান। শিক্ষাজীবনে অর্জন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি।
কাজী আজিজুর রহমান একাধারে শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধি ছিলেন। অর্থবিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই ছিল তার হাতের মুঠোয়। তবে ক্ষমতার এত কাছে থেকেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। অর্থের মোহ তাকে কোনদিনই গ্রাস করতে পারেনি। তিনি দুর্নীতির কালিমা লাগতে দেননি গায়ে। জীবনের ৭৫টি বসন্তই ব্যয় করেছেন জনসেবায়। তার মধ্যে ৪৫টি বছর কাটিয়েছেন মানুষ গড়ার কাজে। তৈরি করেছেন দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা ইত্যাদি। তার হাতে গড়া হাজারো ছাত্র আজ সাফল্যের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্বব্যাপী। ক্ষণজন্মা এই মানুষটির জন্ম ১৯৪১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজলার ধরমন্ডল গ্রামে। তার ভ্রমণপিপাসু বাবা সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন সংসারের প্রতি উদাসীন। তিনি ঘুরে বেড়াতেন দেশ-বিদেশে। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার প্রতিও খেয়াল ছিল না তার। তাই চার ভাই-বোনের সবার বড় কাজী আজিজুর রহমান ছোটবেলায় চলে যান তার নানার বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বেলঘর গ্রামে। সেখানেই নানা-নানির আদরে বেড়ে ওঠেন।
কাজী আজিজুর রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের শুরু জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার কৃষক নানার ছিল অভাবের সংসার। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি নানার কৃষিকাজেও সহায়তা করতেন। তবে তার মেধার কাছে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি দারিদ্রতা। প্রতি ক্লাসেই তিনি রেখেছিলেন মেধার স্বাক্ষর। কৃতিত্বের সঙ্গেই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন জগদীশপুর জে সি উচ্চ বিদ্যালয়ে। পড়ালেখার জন্য নানার আলাদা ঘর না থাকায় থাকতেন চাচাতো নানাদের ঘরে। পালা করে নানাদের ঘরে থেকে পড়াশোনা করতেন। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে পাস করেন মেট্রিকুলেশন (এসএসসি)। ১৯৬১ সালে তিনি ছিলেন ওইগ্রামের একমাত্র এসএসসি উত্তীর্ণ ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও তার আসক্তি ছিলো। ফুটবল ও হাডুডু খেলায় ছিলেন সম্যক পারদর্শী। খেলেছিলেন জেলা পর্যায়ে।
এসএসসি উত্তীর্ণের পর কাজী আজিজুর রহমান ভর্তি হন হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজে। জায়গীর থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬৩ সালে ওই কলেজেই ভর্তি হন ডিগ্রিতে (বিকম)। একইসঙ্গে অভাবের সংসারের হাল ধরতে যোগ দেন চাকরিতে। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশা দিয়েই শুরু করেন কর্মজীবন। সেসময় তার বেতন ছিলো ১২৪ টাকা। তিনি ২৪ টাকা নিজের খরচের জন্য রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দিতেন বাড়িতে। সেসময় শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। তিনি সহজেই মিশে গিয়েছিলেন ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে। জড়িয়ে পড়েছিলেন আত্মীয়তার বন্ধনে। গজনাইপুর গ্রামের মমতাময়ী এক মা তাকে দিয়েছিলেন সন্তানের স্বীকৃতি। এর মধ্যে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন এলাকার রাজনীতিতে। নিয়মিত সালিশ-বিচারে অংশ নিতেন। স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। চাকরির পাশাপাশি নিজের পড়ালেখা সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়ে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান কাজী আজিজুর রহমানের জন্মদাত্রী মা। অকালে মা হারানোটা তিনি সহজে মেনে নিতে পারেননি। অভিমানে বিয়ে করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এরপর আর দীর্ঘদিন গ্রামের বাড়িতে আসেননি। থাকতেন দিনারপুরেই। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিনারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প তৈরি করে। স্কুলের বেঞ্চ ভেঙে রান্না-বান্নার কাজে ব্যবহার করতো হানাদাররা। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। পাক বাহিনী তাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। এক পর্যায়ে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নিয়ে যায় গানপয়েন্টে। এসময় অপর এক পাঞ্জাবি অফিসারের সুমতিতে সেবার প্রাণে বেঁচে যান তিনি। স্বাধীনতার পর ফের ওই স্কুলে শিক্ষকতায় ফিরে যান। ৭৬-৭৭ সালের দিকে শিক্ষকতার পাশাপাশি শুরু করেন আইপিও (ইউরোপে লোক পাঠানো) ব্যবসা। তখন দুই হাতে অর্থ উপার্জন করতেন। স্বাবলম্বী করেছিলেন পরিবারকে। কিন্তু ৭৮ সালের দিকে রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার থেকে ব্যবসা ছেড়ে শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করেন। ৮০ সালে বাবার চাপাচাপিতে বিয়ে করতে সম্মতি দেন। ওই বছরই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শাহবাজপুর গ্রামের সৈয়দা লতিফা বেগমের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে তিনি চার ছেলে ও এক মেয়ের জনক। এরপর আরও তিন বছর ওই স্কুলেই শিক্ষকতা করেন। ’৮৩ সালের শেষের দিকে ইংরেজি বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর জে সি উচ্চ বিদ্যালয়ে।
কাজী আজিজুর রহমানের রক্তে মিশেছিল ‘রাজনীতি’। নিজ এলাকায় শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তৎকালীন কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মো. কায়সারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। মন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তিনি অংশ নিতেন। ওই বছর তিনি জগদীশপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে অল্প ভোটে হেরে গেলেও ’৮৮ সালে পুনরায় ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। হতদরিদ্র কৃষক পরিবাওে জন্ম নেয়া ছেলেটি হয়ে ওঠেন ওই এলাকার জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি। শিক্ষকতার পাশাপাশি সামাল দেন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। তৈরি করেন বেলঘর-খাটুরা গ্রামের আড়াই কিলোমিটার নতুন রাস্তাসহ বিভিন্ন গ্রামের কাচা-পাকা সড়ক। প্রতিষ্ঠা করেন বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তৎকালীন সময়ে প্রতিদিনই ইউপি চেয়ারম্যান কাজী আজিজুর রহমানের বাড়িতে জগদীশপুর ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের ভীড় লেগে থাকতো। বুদ্ধি-পরামর্শ ও বিচার সালিশের জন্য মানুষ তার কাছে ছুটে আসতো। তিনি যথাযথ ভাবে সবার সমস্যাই সমাধান করে দিতেন। ’৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় সরকারি বরাদ্দের বিপুল পরিমাণ ত্রাণ তিনি স্থানীয় দরিদ্রদের মধ্যে সুষম ভাবে বণ্টন করেন। তৎকালীন কোটি কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ বণ্টন করে দিতেন ইউপি সদস্যদের। কোন ধরণের দুর্নীতি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। সততা ও নিষ্ঠার সাথে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দীর্ঘ রাজনীতিক জীবনে তিনি একটি মামলারও শিকার হননি।
জীবদ্দশায় তিনি দীর্ঘদিন জগদীশপুর বাজার জামে মসজিদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসঙ্গে মাধবপুর উপজেলা শিক্ষক সমিতির সদস্য, জগদীশপুর জে সি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি, তেমুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদে সভাপতি এবং জগদীশপুর চা বাগানস্থ হযরত মানিক শাহ (রহ.)-এর মাজার কমিটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে বিলেতপ্রবাসী এক ছাত্র তাকে প্রবাস গমনের অফার দিলে জনসেবার টানে তিনি ফিরিয়ে দেন সেই প্রস্তাব। তিনি সারা জীবন পরোপকার করেছেন।
২০০৬ সালে শিক্ষকতার মহান পেশা থেকে অবসরে যান কাজী আজিজুর রহমান। তবে ওই পেশার মায়া তিনি ছাড়তে পারেননি। অবসরের পরও দুই বছর খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৫ বছর বয়সে ২০১৬ সালের ৪ঠা জুন তিনি নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। পারিবারিক কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়। প্রয়াত এই শিক্ষকের ৪র্থ মত্যুবার্ষিকীতে তার আত্মার মাগফেরাত কামনায় সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
Leave a Reply