1. [email protected] : Touhidul islam Robin : Touhidul islam Robin
  2. [email protected] : Mozammel Alam : Mozammel Alam
  3. [email protected] : nakshibarta24 :
বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২৯ অপরাহ্ন
১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আদরের রাসেল

  • প্রকাশকালঃ রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০
  • ২৩৭ জন পড়েছেন

জাফর ওয়াজেদ :


বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকে বাবা প্রথমেই তাকে খুঁজতেন। ভরাট কণ্ঠে হাঁক দিতেন তার নাম ধরে। তিন চাকার সাইকেল ছেড়ে তড়িঘড়ি দৌড়ে এসে চড়ে বসত বাবার কোলে। বাবার চশমাটাকে দারুণ লাগত তার। হাত দিয়ে টেনে নিয়ে বাবার চোখ, গোঁফ, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত কখনও-সখনও। বাবা তাকে গল্প শোনাতেন, রূপকথা নয়, একটি নিপীড়িত দেশ ও তার মানুষ এবং সংগ্রাম করে তাদের স্বাধীনতা লাভই ঘুরেফিরে আসত গল্পগাথায়। সেই সঙ্গে ছোট্ট দশ বছর বয়সী শিশুটির নানা কৌতূহলের জবাব দিতেন। পিতা-পুত্র যেন এক অন্য জগতে, অন্য আমেজে স্বর্গীয় সুধায় আপ্লুত হতো। পুত্রের কথা বলার ভঙ্গিটাও ছিল বেশ মজাদার। বরিশাল, ফরিদপুর ও ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা ও উর্দু মিশিয়ে একটা নিজস্ব ভাষা ওর গড়ে উঠেছিল। সেই ভাষায় যখন কথা বলত, বাবা হেসে উঠতেন। তিনিও চেষ্টা করতেন জগাখিচুড়ি ভাষায় জবাব দিতে।

পিতা-পুত্র যেন অন্তঃপ্রাণ। বাবাকে যে সে সব সময় পেত, তা নয়। বাবা অন্য বাসায় চলে গেলে তার মন খারাপ হতো। মায়ের সঙ্গে যেদিন সব ভাইবোন মিলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বাবাকে দেখতে যেত, সেদিন ফেরার সময় খুব কাঁদত, একবার তো বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় বেশ মনভার নিয়ে জেলখানা থেকে বাসায় ফিরে বোনদের বলল, ‘আব্বা আসল না। বলল, ওটা তাঁর বাসা, এটা আমার বাসা। এখানে পরে আসবেন।’ বাবার সঙ্গ তেমন পেত না। বাবাকে প্রায়ই গ্রেফতার হয়ে জেলে যেতে হতো। বন্দী করে রাখত বাবার গল্প বলা সেই জল্লাদরা। তার জন্মের পর দীর্ঘ সময় বাবা জেলেই কাটিয়েছেন। মুক্ত বাবাকে ভয় পেত শাসকরা। বাবাকে দীর্ঘ সময় দেখতে না পেয়ে তার মন খারাপ থাকত। বাবার কাছে যাওয়ার জন্য অনেক সময় মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে কাঁদত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। স্বপ্নে দেখত, বাবা তাকে গল্প শোনাচ্ছেন, কখনও বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন। তার এই খারাপ লাগাটা ভাইবোনদেরও কষ্ট বাড়াত।

পিতার জেলে যাওয়া, মুক্তি পাওয়া জীবনকে অবশ্য তারা সয়ে নিয়েছিল। বাবার অবর্তমানে তাই সে মাকেই আব্বা বলে ডাকত কখনও কখনও। মন খারাপ, চাপা দেয়ার জন্য মায়ের কিনে দেয়া তিন চাকার সাইকেলটি নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকত। কিন্তু রাত হলেই চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ থাকত। বাবা কারাবন্দী থাকাকালে এমনিতেই বাড়িটা খুবই নীরব থাকত। লোকজনের তেমন যাতায়াত ছিল না। বাঙালীর মুক্তি সনদ ছয় দফা যখন বাবা ঘোষণা করেন, আর এই কারণে জেলে যান, তখন তার বয়স দেড় বছর ছাড়িয়ে।

১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় তার জন্ম হয় বড় বোনের শয়নকক্ষে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট্ট সে। তাই সে ছিল সবার আদরের। অনেক বছর পর একটি ছোট্ট শিশু বাড়িটিকে আলোকিত করে তোলে। বাবা ছিলেন ভীষণ পড়ুয়া। জেলে বসে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ছিল বাবার খুব প্রিয় লেখক। মাঝে মাঝে মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন বাবা রাসেলের দার্শনিকতা। এসব শুনে রাসেল ভক্ত হয়ে ওঠা মা নিজের ছোট সন্তানের নাম রাখলেন রাসেল। চার বছর বয়সে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হয় ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে। নাম রাখা হয় শেখ রাসেল উদ্দিন। বড় ভাইবোনরা পালা করে তাকে স্কুলে আনা-নেয়া করত। বাসায় ছিল ছোটখাটো একটা লাইব্রেরী। আলমারিভর্তি বাবার সংগৃহীত বইপত্র। বোনরা তাকে গল্প পড়ে শোনাত। একই গল্প ক’দিন পর শোনানোর সময় দু-এক লাইন বাদ পড়লে সে ঠিকই ধরে ফেলত। বলত ও, সেই লাইনটা পড়নি কেন? তার প্রিয় খাবার ছিল চকলেট, সমুচা, কোক। তবে পোলাও এবং ডিম পোচ এমনকি ঢেঁড়স চিনি মিশিয়ে খেত। চলাফেরায় বেশ সাবধানী এবং সাহসী ছিল। কোন কিছুতে তেমন ভয় পেত না। কালো কালো বড় পিঁপড়ে দেখলে ধরতে যেত। পিঁপড়েরাও দে ছুট। কোনটা পড়ত লুকিয়ে। একবার একটা বড় পিঁপড়ে ধরে ফেলল। পিঁপড়েটাও আঙুলে কামড় বসাল। যন্ত্রণাকাতর রাসেল তখন। আঙ্গুলটা ফুলে যায়। এরপর থেকে আর পিঁপড়ে ধরত না। কিন্তু ওই পিঁপড়ার একটা নামও দেয়। কালো পিঁপড়ে দেখলে ডাকত ‘ভুট্টো’ বলে। রাসেলের কথা ও কান্না টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে রাখতেন ওর বড় বোন হাসুপা। সে যদি কোন কারণে কান্নাকাটি করত, তখন বোনরা টেপ ছেড়ে দিলে থেমে যেত তার কান্না। চুপ হয়ে ঝিম ধরে বসে থকত। টেপে তার কান্না বাজালে অনেক সময় মা দৌড়ে আসতেন কান্না থামাতে। কিন্তু দেখতেন তারা হাসছে। পোশাক পরা নিয়েও ছিল খুব সচেতন। বাবার মতো প্রিন্স কোট, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট পরত। মাছ ধরার শখও ছিল। টুঙ্গিপাড়ায় গেলে পুকুরে মাছ ধরত। গণভবনেও সে মাছেদের খাবার খাওয়াত। বাসায় কবুতরের ঘর ছিল, অনেক কবুতর থাকত। মা খুব ভোরে উঠে তাকে কোলে নিয়ে কবুতরদের খাবার দিতেন। হাঁটতে শেখার পর নিজেই কবুতরের পেছনে ছুটত, নিজ হাতে খাবার দিত। কিন্তু কবুতরের মাংস কখনও খেত না। বাড়িতে টমি নামে একটা পোষা কুকুর ছিল। তার সঙ্গে ওর খুব বন্ধুত্ব ছিল। তার সঙ্গে খেলা করত। একদিন খেলার সময় টমি জোরে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠলে, রাসেল ভয় পেয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ছোট আপাকে বলে, টমি বকা দিচ্ছে। অথচ নিজের খাবারের ভাগও দিত টমিকে। আর সেই টমি তাকে বকা দিয়েছে। এটা সে মেনে নিতে পারত না। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পরদিন বাসায় আক্রমণ চালায়। তাদের ছোড়া গুলির খোসা এসে রাসেলের পায়ের ওপর পড়ে। মা তাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে বাথরুমে লুকিয়ে রাখেন। পরে তারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। বিভিন্ন জনের বাসায় আশ্রয় নেন। কিন্তু ধরা পড়ার পর তাদের ধানম-ির ১৮ নম্বরের একটি বাড়িতে আটক রাখা হয়। নয় মাসের বন্দীজীবন তখন রাসেলেরও। স্বাধীনতার পর বাবা ফিরে এলে, বাবার সঙ্গে সব সময় ছায়ার মতো লেগে থাকত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে বাবা, মা, ভাই, ভাবিদের হত্যাকান্ড স্বচক্ষে দেখতে হয়েছে তাকে। বাসার কাজের লোকদের সঙ্গে তাকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে। সে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদতে থাকে। ঘাতকরা তাকে মৃত মায়ের মাছে নিয়ে গিয়ে গুলিতে তার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। দশ বছর বয়সী শিশুটির জীবনপ্রদীপ ঘাতকরা নির্মমভাবে নিভিয়ে দেয় চিরদিনের জন্য।

অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন

ছবিঃ মোঃ সাইদুল ইসলাম

-জনকণ্ঠ

খবরটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো খবর

বিজ্ঞাপন

Laksam Online Shop

first online shop in Laksam

© All rights reserved ©nakshibarta24.com
কারিগরি সহায়তায় বিডি আইটি হোম