মোঃ মনির উদ্দিন মান্না, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে :
একই পৃথিবী কিন্তু এর ভুখন্ডগুলোর প্রত্যেকের বর্ণ, আকৃতি ও বৈশিষ্ট আলাদা। একই জমি ও একই পানি, কিন্তু তা থেকে বিভিন্ন প্রকার ফল ও ফসল উৎপন্ন হচ্ছে। একই গাছ কিন্তু তার প্রত্যেকটি ফল একই জাতের হওয়া সত্ত্বেও তাদের আকৃতি, আয়তন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। একই মূল থেকে দুটি ভিন্ন গাছ বের হচ্ছে এবং তাদের প্রত্যেকই নিজের একক বৈশিষ্টের অধিকারী। যে ব্যক্তি এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে সে কখনো মানুষের স্বভাব, প্রকৃতি, ঝোঁক-প্রবণতা ও মেজাজের মধ্যে এতবেশি পার্থক্য দেখে পেরেশান হবে না। যদি আল্লাহ চাইতেন তাহলে সকল মানুষকে একই রকম তৈরি করতে পারতেন কিন্তু যে জ্ঞান ও কৌশলের ভিত্তিতে আল্লাহ এ বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করেছেন তা সমতা, সাম্য ও একাত্মতা নয় বরং বৈচিত্র ও বিভিন্নতার প্রয়াসী। সবাইকে এক ধরনের করে সৃষ্টি করার পর তো এ অস্তিত্বের সমস্ত জীবন প্রবাহই অর্থহীন হয়ে যেত।
আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, আর তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। তারপর তার সাহায্য সব ধরনের উদ্ভিদ উৎপাদন করেছন। এরপর তা থেকে সবুজ শ্যামল ক্ষেত ও বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। তারপর তা থেকে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা উৎপাদন করেছেন। আর খেজুর গাছের মাথি থেকে খেজুরের কাঁদির পর কাঁদি সৃষ্টি করেছেন, যা বোঝার ভারে নুয়ে পড়ে। আর সজ্জিত করেছেন আঙুর, যয়তুন ও ডালিমের বাগান। এসবের ফলগুলো পরস্পরের সাথে সাদৃশ্যও রাখে আবার প্রত্যেকে পৃথক বৈশিষ্টেরও অধিকারী। গাছ যখন ফলবান হয় তখন এর ফল ধরা ও ফল পাকার অবস্থাটি একটু গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করো এসব জিনিসের মধ্যে ঈমানদারদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। (সূরা-আল আনআম, আয়াত-৯৯)।
১। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত তীন গাছ
وَالتِّينِ وَالزَّيْتُونِ
ওয়াত্তীনি ওয়াযাইতূনি। পবিত্র কোরআনে কারিমের ত্রিশতম পারার ৯৫ নম্বর সূরার প্রথম আয়াত এটি।
বর্ণিত সূরায় আল্লাহতায়ালা তীন গাছের নামে শপথ করেছেন। সূরার প্রথম শব্দ তীন অনুসারে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে- সূরা আত-তীন। তীনের বাংলা অর্থ আঞ্জীর বা ডুমুর।
মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম এশিয়ায় এ ফলের উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে করা হয়।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। আফগানিস্তান থেকে পর্তূগাল পর্যন্ত এই ফলের বাণিজ্যিক চাষ হয়ে থাকে। তবে শখের বসে মানবতার কবি ফখরুল ইসলাম খান সি আই পি সংযুক্ত আবর আমিরাত আজমান মুহিত নিজ বাড়ীতে একটি তীন গাছ লাগানো হয়। বর্তমানে গাছটি সবলভাবে বেড়ে উঠছে। ইনশাআল্লাহ ফলও ধরবে খুব তারাতারি ।
মানবতার কবি ফখরুল ইসলাম খান সি আই পি বলেন- পবিত্র কোরআনে বর্ণিত সূরা তীন যে গাছের নামে সেই তীন গাছ আমার বাড়ীতে থাকায় অনেকে এটি দেখতে আসেন। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের গুরুত্বপূর্ণ সূরা ইয়াসিনের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র মহান তিনি, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং ওরা (অবিশ্বাসী) যাদের জানে না, তাদের প্রত্যেককে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।’ কেবল এই বিশ্বই নয়, কেয়ামতের পর পুণ্যবান ব্যক্তিদের ঠিকানা বেহেশতেও হবে বৃক্ষশোভিত। এ বিষয়ে সূরা আর রহমানের ৪৬ থেকে ৬৮ নম্বর আয়াতের বর্ণনা মতে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে, তার জন্য রয়েছে দুটো বাগান। এই বাগান দুটি ঘন শাখা-প্রশাখায় ভরা থাকবে। সেখানে উপচে পড়বে দুটি ঝরনা। এর বাইরে আরও দুটি ঘন সবুজ বাগান থাকবে, যার মাঝেও বয়ে যাবে দুটি উচ্ছলিত ঝরনা। নেয়ামত হিসেবে সেই বাগানে থাকবে ফলমূল।
জানা যায়, আঞ্জির হচ্ছে ডুমুর জাতীয় এক ধরনের ফল। এর গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Ficus carica । ফাইকাস গণভুক্ত প্রায় ৮০০ প্রজাতির মধ্যে আঞ্জির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। এই ফলের আকার কাকডুমুরের চেয়ে বড়; এটি একটি জনপ্রিয় মিষ্টি ও রসালো ফল। হিন্দি, মারাঠি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় এই ফলকে আঞ্জির বলা হয় এবং আরবি ভাষায় এর নাম তীন। এ গাছ ৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
পবিত্র কোরআনে এই ফলকে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত বা অনুগ্রহরূপে ব্যক্ত করা হয়েছে। বাইবেলেও এই ফলের কথা উল্লেখ রয়েছে।
২। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত খেজুর গাছ
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, আর দেখ, পৃথিবীতে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন আলাদা আলাদা ভূখ-, রয়েছে আঙুর বাগান, শস্যক্ষেত, খেজুর গাছ- কিছু একাধিক কা-বিশিষ্ট আবার কিছু এক কাণ্ড বিশিষ্ট, সবাই সিঞ্চিত একই পানিতে কিন্তু স্বাদের ক্ষেত্রে আমি করে দেই তাদের কোনটাকে বেশি ভালো এবং কোনটাকে কম ভালো।
এসব জিনিসের মধ্যে যারা বুদ্ধিকে কাজে লাগায় তাদের জন্য রয়েছে বহুতর নিদর্শন। (সূরা-আর রাদ, আয়াত-০৪)
নবী মুহাম্মদ (সা.) তার একটি হাদিসে হজরত আব্দুল্লাহ বিন উমরের (রা.) বর্ণিত হাদিসে বলেছেন, গাছের মধ্যে একটি গাছ আছে যা একটি মুসলিম অনুরূপ। তার পাতা পড়ে না ওই গাছটা কি? নবী (সা.) নিজেই বলেছিলেন, এটাই খেজুর গাছ।
৩। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত জয়তুন গাছ
মহানবী (সা.)-এর পছন্দের ফলগুলোর একটি ছিল জয়তুন। জয়তুনের তেল শরীরের জন্য বেশ উপকারী। রাসুল (সা.) নিজে ব্যবহার করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও জয়তুনের তেল ব্যবহারের তাগিদ দিতেন। হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা (জয়তুনের) তেল খাও এবং তা শরীরে মালিশ করো। কেননা এটি বরকত ও প্রাচুর্যময় গাছের তেল। (তিরমিজি, হাদিস : ১৮৫১)
কোরআনে বর্ণিত ফলগুলোর অন্যতম একটি ফল জলপাই বা জয়তুন। সুরা ত্বিনের প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ যে ফলের কসম খেয়েছেন। এই ফলের গাছকে আখ্যা দিয়েছেন মুবারক গাছ হিসেবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ আসমানসমূহ ও জমিনের নুর। তার নুরের উপমা একটি দীপাধারের মতো। তাতে রয়েছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি রয়েছে একটি চিমনির মধ্যে। চিমনিটি উজ্জ্বল তারকার মতোই। প্রদীপটি বরকতময় জয়তুন গাছের তেল দ্বারা জ্বালানো হয়, যা পূর্ব দিকেরও নয় এবং পশ্চিম দিকেরও নয়। এর তেল যেন আলো বিকিরণ করে, যদিও তাতে আগুন স্পর্শ না করে…। (সুরা নুর, আয়াত : ২৪)
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ যে জয়তুনের প্রশংসা করেছেন, তা জন্ম নেয় সিনাই পাহাড়ে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর এক বৃক্ষ যা সিনাই পাহাড় হতে উদ্গত হয়, যা আহারকারীদের জন্য তেল ও তরকারি উৎপন্ন করে।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ২০)
তাফসিরবিদরা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে জয়তুনের কথা বলা হয়েছে। (তাফসিরে তবরি)
মহান আল্লাহ বরকতময় এই গাছটির কথা শুধু কোরআনেই নয়, বরং পূর্ববর্তী কিতাবেও উল্লেখ করেছেন। যার ফলে ইহুদিরা এই গাছের পাতা শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখে।
৪। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ডালিম গাছ
পবিত্র কুরআন শরীফের “রুম্মান” শব্দের বাংলা পরিভাষা আনার বা ডালিম, যা অনেকবার বিভিন্ন সূরায় এসেছে। [সূরা আল আন-আম: আয়াত ৯৯ ও ১৪১; সূরা আর রহমান: আয়াত নং ৬৮ চেক করতে পারেন]
রাসূল (সা:) বলেন, “ডালিম তোমাকে শয়তানী আকাংখা থেকে ৪০ দিন রক্ষা করবে”। অন্য এক হাদীসে উল্লেখ আছে যে, রাসূল (সা:) বলেন এমন একটি ডালিম নেই যেটাতে জান্নাতের ডালিমের একফোঁটা রস নেই।” অর্থাৎ ডালিমে জান্নাতের একফোঁটা পানীয় রয়েছে। সুবহানাল্লাহ্ হযরত আলী (রা:) বলেন, “যে ডালিম খায় তার অন্তরের আল্লাহ থাকেন।
চলবে………..
Leave a Reply