অদম্য ইনা :
ইনা, ইনা ত্রিপুরা। জুম চাষী মা-বাবার ঘরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দুর্গম কুড়াদিয়া ছড়ার লম্বাপাড়া গ্রামে জন্ম। তিন বছর বয়সে মানসিক রোগী মা পিত্রালয়ে চলে গেলে জুমিয়া বাবাকে জীবিকার তাগিদে একা মাঠে কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো। আর্থিক অসচ্ছলতা ও মাতৃস্নেহবণ্চনার মাঝে বেড়ে উঠা ইনার ছিল পড়াশোনার প্রতি গভীর মনযোগ। বাবার সাথে জুম ক্ষেতে গেলেও সাথে নিয়ে যেত স্কুলের বই। বাবা লেখাপড়া না জানলেও মেয়ের পড়াশোনায় উৎসাহ দিতেন। নারী শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহী পাড়াপ্রতিবেশিদের সমালোচনা গ্রাহ্য করতেননা।
সংগ্রামী নারী ইনা নানা প্রতিকূলতাকে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে অতিক্রম করেছেন। অনেক কষ্টে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে এবং টিউশনি করে পানছড়ি হাইস্কুলে হতে এসএসসি ও খাগড়াছড়ি কলেজ হতে এইচএসসি পাশ করেন। কলেজে পড়ার সময় বাবা মারা গেলে মুখোমুখি হন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের। কিন্তু অদম্য ইনা থেমে থাকেননি। সহপাঠীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইনা তখন খাগড়াছড়ির যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গবাদি পশু পালনের উপর প্রশিক্ষণরত।
২০০৬ সনে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে মেধাবী ইনা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত Mirinda House College এ সমাজবিদ্যায় স্নাতক পড়তে গেলে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তবে এখানেও তাকে জয় করতে হয়েছে নানা বাধা ও প্রতিবন্ধকতা। খাগড়াছড়ি থেকে দিল্লি। অনুন্নত পশ্চাৎপদ পার্বত্য শহর থেকে ভারতের রাজধানীর ঝলমলে পরিবেশে নিজেকে খাপ খায়িয়ে নিতে হয়েছে। প্রথম ছয়মাস ক্লাসের ইংরেজি লেকচার বুঝতে খুব কষ্ট হতো। ইংরেজি শব্দের বানান, অর্থ ও উচ্চারণ শেখার জন্য ইনা এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সহপাঠী ভারতীয় সুমনের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে ইনা প্রতিদিন তাকে ক্লাসে নিয়ে যেত। ক্লাস শেষে সুমন ব্রেইলিতে লেখা লেকচার বানান করে ইনাকে পড়ে শোনাত। আবার ইনা টেক্সট বই পড়ে শোনালে সুমন সহজভাবে ইনাকে বুঝিয়ে দিত।
এভাবে কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে ২০০৯ সনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসে ইনা UNDP এর CHTDF প্রকল্পে কাজ করার সময় দিল্লির South Asian University তে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য বৃত্তি পান। একই সময়ে তিনি AusAid এর বৃত্তি ও পান। এবার ভারতে না গিয়ে তিনি অষ্ট্রেলিয়ায় যান এবং Flinders University থেকে one of the top 15% students হিসেবে Golden Key Honorary Membership Award সহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ২০১৪ সনে দেশে ফিরে আসেন। এখানে হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল সহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থায় নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিয়ে চার বছর কাজ করার পর আবার বৃত্তি নিয়ে অষ্ট্রেলিয়া চলে যান। বর্তমানে ইনা ত্রিপুরা দক্ষিন অষ্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে UN Humanitarian Gender Policy Analysis এর পিএইচডি গবেষক হিসেবে অধ্যয়নরত।
আমি অদম্য ইনার উত্তরোত্তর সাফল্য ও কল্যান কামনা করছি।
Leave a Reply