বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘বীর নিবাস’ নামে ১৪ হাজার বাড়ি নির্মাণ করে দেবে সরকার। দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসনের জন্য তৈরি করে দেওয়া হবে একতলা বাড়ি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে চলমান ‘মুজিববর্ষ উদযাপন’ কর্মসূচির আওতায় এবং আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উপহার হিসেবে এই উপহার পাবেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
‘বীর নিবাস’ প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণসহ অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চলতি অর্থবছরেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের নকশার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তালিকা নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে বাড়ি নির্মাণ করা হবে, তার নাম ঠিক করা হয়েছে ‘বীর নিবাস’। এসব বাড়ি হবে একতলার। থাকবে তিন বেডরুম ও একটি ড্রইং-ডাইনিং। চার ডেসিমেল জমিতে ৯০০ বর্গফুট আয়তনের একেকটি ভবনের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়ি নির্মাণের কার্যক্রম অনেকটা পিছিয়ে গেছে। তবে বর্তমান অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়েই এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। এ লক্ষ্যে আগ্রহী অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার আবেদন সংগ্রহ বা তার সম্মতির ভিত্তিতে জেলা ও উপজেলাওয়ারি তালিকা পাঠাতে দেশের সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলা পর্যায়ে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ বিষয়ে বলেন, ‘দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চলতি অর্থবছরই ১৪ হাজার অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাকে এই বাড়ি উপহার দিয়ে সম্মানিত করতে চাই। এটি হবে মুজিববর্ষের প্রকল্প।’ মন্ত্রী আরো বলেন, ‘আগে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হলো, অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা তাদের বসতভিটা ছেড়ে যেতে চান না। তখন অনেকে বরাদ্দ পেয়ে ফ্ল্যাটগুলো অন্যভাবে (ভাড়া বা বিক্রি) ব্যবহার করেন। এ জন্য আমরা অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ ভিটাতেই বাড়ি করে দিতে প্রকল্পটি নিয়েছি। যাদের জমি নেই, তাদের জমিসহ বাড়ি করে দেওয়া হবে।’
মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সুপারিশসহ তালিকা পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক তালিকা যাচাই করবেন। এরপর জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের সুপারিশ অনুসারে চূড়ান্ত তালিকা মন্ত্রণালয়ে আসবে। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এর আগে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারসহ দেশের অন্য জেলাগুলোতে ৯০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ভূমিহীন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ২০১৮ সালে ৬০০ বর্গফুটের ঘর (বীর নিবাস) নির্মাণ করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে এবার ফ্ল্যাট নির্মাণ থেকে সরকার সরে এসেছে। যে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর নিবাস’ দেওয়া হচ্ছে, তার কোনো তালিকা নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে। তবে ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই উপজেলা পর্যায়ে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন চূড়ান্ত করা হবে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দেশে ২ লাখ ১১ হাজার গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা আছেন।
প্রকল্পের আওতায় বাড়ি নির্মাণের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি নীতিমালাসহ নির্দেশিকা জারি করা হয়। নির্দেশিকা অনুযায়ী, অসচ্ছল বলতে যাদের বার্ষিক আয় (মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা ছাড়া) ৬০ হাজার টাকার নিচে এবং নিজস্ব কোনো বাড়িঘর নেই বা কুঁড়েঘরে থাকেন, এমন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্দেশ করবে। এ ছাড়া আবাসন বরাদ্দের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অযোগ্যতা এবং বরাদ্দ প্রক্রিয়ার বিষয়ে নীতিমালা হিসেবে আবেদনকারীকে গেজেটভুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আবেদন যোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, যেসব অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ-প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী ও সন্তানের আগে মন্ত্রণালয় বা কোনো সরকারি দপ্তর বা সংস্থা থেকে প্লট, ফ্ল্যাট বা আবাসন বরাদ্দ পাননি কিংবা আবাসনের জন্য কোনো ঋণ পাননি তারাই আগামীতে ‘বীর নিবাস’ প্রকল্পের আওতায় আবাসন বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করতে পারবেন। তবে স্ত্রী ও সন্তানের একাধিক ওয়ারিশের ক্ষেত্রে কো- শেয়ারধারীদের ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অনাপত্তিপত্র দিতে হবে। যেসব অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও সন্তানের মালিকানায় কোনো ভিটাজমি নেই, তাদের অনুকূলে আবাসন নির্মাণের উপযোগী খাসজমি দখলে থাকলে কিংবা খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব হলে জমি বন্দোবস্ত করা হবে।
বাড়ি বরাদ্দে অগ্রাধিকার বিবেচনা হিসেবে নির্দেশিকায় বলা হয়, বীরাঙ্গনাদের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যাচাই ছাড়াই আবেদনটি সরাসরি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। মন্ত্রণালয় যাচাইয়ের পর তাদের আবাসন বরাদ্দ দেবে। একইভাবে অসচ্ছল ভূমিহীন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা (শেরপুরের বিধবা পল্লী কিংবা অনুরূপ স্বীকৃত কোনো বিধবা পল্লীর) ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-সন্তান, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীকে (অসচ্ছল-ভূমিহীন হলে) অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
Leave a Reply