জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
সাধন সরকার :
প্রত্যেক মানুষই তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে, ভালোবাসে প্রিয় মাতৃভূমিকে। এক কথায়, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা প্রত্যেক মানুষের কাছে পরম প্রিয় বিষয়। বাঙালি জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছে। পৃথিবীতে শুধু বাঙালি জাতিরই বিশেষ একটি বিশেষত্ব আছে, আর তা হলো বাঙালির মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা উভয়-ই ‘বাংলা’। আবার দেশের নাম অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে ‘বাংলা’ শব্দটি জড়িয়ে আছে। এই বাংলায় অবিভক্ত ভারতের নানা সংকট ও সমস্যাসংকুল প্রতিবেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক ছোট্ট শিশু। পরে এই ছোট্ট শিশুই বাংলা ও বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার সূচনা করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে একের পর এক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তারই নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায়। ভাষা আন্দোলন-বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাথা। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ।
জাতির পিতা শুধু বাঙালির স্বাধীনতা এনে দেননি, তিনি বাঙালির ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ছিলেন অগ্রগণ্য। যেকোনো জাতির জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। মানুষের আবেগ-অনুভূতি, ভালোলাগা-মন্দলাগা, দুঃখ-কষ্ট, সৃষ্টি-কর্ম সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাষা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশে রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা করেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব, অতঃপর রাষ্ট্রভাষার অধিকার আদায়, বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং স্বাধীনতার পরেও বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মূলত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আসনে আসীন করার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের গোড়াপত্তন হয়। ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই বাঙালির স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।
১৯৪৭ সালের আগেই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবির কথা উঠলেও তা জোরালো ছিল না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম এবং বাঙালির জেগে ওঠার আন্দোলন হলো ভাষা আন্দোলন। ভারতবর্ষ ভাগের পর পাকিস্তানের দুটো প্রদেশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ভাষাসহ অন্য সব ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সব ধরনের নিপীড়ন, বৈষম্য ও বঞ্চনায় অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার জনগণ প্রতিরোধের পথ বেছে নেয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন তারুণ্যের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের লেখা থেকে পাওয়া যায়, মূলত সেদিনের প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।’ এভাবেই বাংলা ভাষার দাবি প্রথম উচ্চারিত হওয়ার মধ্য দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর গ্রহণ অভিযানে এবং ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেন। এ সময় তমদ্দুন মজলিসসহ ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বহু কাজে তিনি এগিয়ে আসেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল’ নামক একটি পুস্তিকা প্রণয়ন করা হয়। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা-সংক্রান্ত। এই পুস্তক প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন এটির অন্যতম স্বাক্ষরকারী।
১৯৪৮ সাল থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের দাবি জোরদার হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবি ছিল। এই দাবির মধ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি ছিল অন্যতম। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন গণপরিষদের অধিবেশনে বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তার মন্তব্যে পূর্ববাংলায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষাবিরোধী পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগের কার্যক্রম সম্পর্কে জাতির পিতা সদা সতর্ক ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম হরতাল পালিত হয় এবং এই হরতালের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই হরতাল তথা ধর্মঘট থেকে শেখ মুজিবসহ আরো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ প্রসঙ্গে জাতির পিতা তাঁর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচায় (বাংলা একাডেমি-২০১৭ থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-২০৬) লিখেছেন, ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ওইদিন ১০টায় আমি, শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আবদুল ওয়াদুদসহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হন।’ কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিবসহ অন্য ছাত্রনেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির সুবাদে শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ সভা করতে চাইলেও সেখানেই পুলিশ বাধা দেয়। এর প্রতিবাদে শেখ মুজিব ১৭ মার্চ ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। ১৯ মার্চ পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্রষ্টা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বলেন, ‘উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র তাৎক্ষণিকভাবে ‘নো’ ‘নো’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায়। বাংলা ভাষার আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ভাষার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ ব্যাপকমাত্রায় কাজ করে যেতে থাকে। ১৯৪৮ সালের তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান ২৮ বছর বয়সে ভাষার অধিকার আদায়ে ন্যায়সংগত সব আন্দোলনে জনগণের পাশে থেকে কাজ করে যেতে থাকেন। এক কথায়, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ওতপ্রোতভাবে কাজ করে যান। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়, যাতে লেখা ছিল ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।’ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পদত্যাগ করলে ক্ষমতার পালাবদলে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুরে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ আন্দোলন শুরু করে এবং ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ পর্যন্ত প্রতি বছর ‘ভাষা আন্দোলন দিবস’ (১১ মার্চকে) হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরে জুলাই মাসের শেষে তিনি মুক্তি পান। ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর আর্মানিটোলা ময়দানে জনসভা শেষে বঙ্গবন্ধু ভুখা মিছিল বের করেন (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা-২০১৭, পৃষ্ঠা-৫)। ওই মিছিল থেকে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। বেশ কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুকে জেলে আটকে রেখে মওলানা ভাসানী ও শামসুল হককে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্নপর্যায়ে পরামর্শ দিতেন।’
পরে ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হলে খসড়া মূলনীতি ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিষয়টি কিছুটা হলেও গতিহীন হয়ে পড়ে! ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন আহমেদ আবার দৃঢ় ভাষায় বলেন, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ অতঃপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ববঙ্গের রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। শাসকগোষ্ঠীর জারি করা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেরা ভাষার দাবিতে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হটকারিতা ও অপরিমাণদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে মিছিলে পুলিশি নির্যাতন ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিকসহ অনেক ভাষাবীর। মুহূর্তেই ঢাকার রাজপথ ভাষা শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে। এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু জেলে অনশন শুরু করেন। অবশেষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়! ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনে বিশাল মিছিলে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এই মিছিল থেকে বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং দৃঢ় কণ্ঠে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। বাংলার কোনো কোনো নেতা বাংলা ভাষার দাবির ব্যাপারে বিপক্ষে অবস্থান করলেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে তারাও ভাষার দাবি আদায়ে শামিল হন। ১৯৫৫ সালে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন আন্দোলনের মুখে বাংলাকে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রায় ৫৬ ভাগ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে কোনোভাবে হেলাফেলা না করার ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে সতর্ক করে দেন। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আইনসভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন। ভাষাসৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে।
লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
[email protected]@gmail.com
Leave a Reply