রাষ্ট্র বলতে একটি ভূ-খণ্ডের আইনত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেই বোঝায়। রাষ্ট্র গঠনের চারটি মৌলিক উপাদানের (ভূমি, জনসংখ্যা, সরকার ও সার্বভৌমত্ব) মধ্যে মুখ্য উপাদান সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌম শব্দটি দ্বারা একটি রাষ্ট্রের চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতাকে বোঝায়। একটি রাষ্ট্রের গঠন পূর্ণতা পায় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ ক্ষমতা রাষ্ট্রকে অন্য যে কোন সংস্থা থেকে পৃথক করে। সার্বভৌমত্ব বৈশিষ্ট্যের দরুন রাষ্ট্র নিজের ইচ্ছা ব্যতিরেকে অন্য কোনো প্রকার শক্তি বা ক্ষমতা দ্বারা আইনসংগত ভাবে আবদ্ধ নয়। নিয়মানুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ই চূড়ান্ত ক্ষমতা কার্যকরী করার জন্য কেবলমাত্র একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থাকে। এ ক্ষমতাই সার্বভৌমত্বের অন্যতম উদাহরণ। অপরদিকে সার্বভৌমের আইন প্রতিষ্ঠিত হয় এর আদর্শকে কেন্দ্র করে। সার্বভৌমের আদর্শ বা আইনের বাধ্যবাধকতা সকলের জন্যই সমান। সার্বভৌম ক্ষমতার দুইটি দিক রয়েছে। একটি অভ্যন্তরীণ দিক অপরটি বাহ্যিক দিক। রাষ্ট্রের সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মূল উৎসই হলো সার্বভৌমের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা। রাষ্ট্রের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই সার্বভৌম ক্ষমতার ঊর্ধ্বে নয়। সার্বভৌমের বাহ্যিক দিকটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ মুক্ত থাকার দিকটি ইংগিত করে। রাষ্ট্র গঠনের অন্য তিনটি মৌলিক উপাদান অর্থাৎ জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার থাকা সত্ত্বেও একটি দেশের সার্বভৌমত্ব না থাকলে তা রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় না। যতদিন রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বিদ্যমান থাকে ততদিন সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্ব থাকবে।
সুদীর্ঘ ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে পূর্ব-পাকিস্তান রূপ লাভ করেও এ অঞ্চলের মানুষ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত ছিল। কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় বাঙ্গালীদের অংশগ্রহণকে অস্বীকার করার পাশাপাশি বাংলা ভাষা তথা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপরেও খড়গ হস্ত হলো পশ্চিম-পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। ১৯৫০-৬০ এর দশকে প্রণীত পাকিস্তানের উন্নয়নের রূপরেখায় পশ্চিম-পাকিস্তানকে একচেটিয়া প্রাধান্য দেয়া হলো। অর্থ নৈতিক নীতিমালার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের সম্পদ দিয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানে শিল্পায়ন এবং পূর্ব-পাকিস্তানের প্রশাসন ও ব্যবসায় অবাঙ্গালীদের প্রতিষ্ঠা করা। ভৌগলিকভাবে দুটি ভূ-খণ্ড পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকার পরেও রাজ নৈতিক, অর্থ নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বঞ্চনা পূর্ব-পাকিস্তানীদের মনে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধের যোজনা তৈরি করে। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাষানীর মত জাদরেল নেতা থাকা সত্ত্বেও পূর্ব-পাকিস্তান এবং পশ্চিম-পাকিস্তান যে এক নয় তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখাকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে কেউই পারেননি। এমনই ক্রান্তিকালে ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজ নৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন। ৬ দফার প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু এই দাবির মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্বকে তুলে আনেন।
“৬ দফা দাবি” পেশ করার পর শাসনক্ষমতা হাত ছাড়া হবার ভয়ে তৎকালীন স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর জেল-জুলুম ও নির্যাতন চালাতে কুণ্ঠাবোধ করলেন না। কিন্তু এই নির্যাতনের প্রতিবাদে পূর্ব-পাকিস্তান এবং পশ্চিম-পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে আইয়ুব খান ক্ষমতাভার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর নানান ঘটনাক্রমে ইয়াহিয়া খান বাধ্য হলেন নির্বাচন দিতে। নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হবে তারাই সংবিধান রচনা করবেন এবং সেই সংবিধানের ভিত্তিতে পাকিস্তান পরিচালিত হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হলো। এ অঞ্চলের মানুষকে বঙ্গবন্ধু যে স্বায়ত্তশাসন, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে উদ্বেলিত করেছিলেন, ১৯৭০-এর নির্বাচনে তার প্রতি এ অঞ্চলের মানুষ পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেন। বিধিবাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের চাতুরতায় বাঙ্গালীদেরও সে স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বভাবসিদ্ধ চেতনা অনুযায়ী জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়নি।
ফলে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার’ আহ্বানের মধ্য দিয়ে সে সময়ের বাঙালি জনগণের চেতনা ও সার্বভৌম ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। জনগণের সার্বভৌমত্বের এই চরম প্রকাশ সম্ভব হয়েছে বহুধাবিভক্ত বাংলাদেশের জনগণকে একত্রিত করে মুক্তি ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কারণে। এই কারণের পেছনে এ দেশের আপামর জনসাধারণের পাশাপাশি, উল্লেখযোগ্য হিসেবে অনেক স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী, নেতা ও ঘটনা জড়িত থাকলেও একজন বঙ্গবন্ধুই এই সবকিছুকে সফলভাবে সমন্বয় করতে ও নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান স্বকীয়তায় ভাস্বর। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি এ দেশের জনগণকে ‘আমার মানুষ’, ‘বাঙালি’ প্রভৃতি অভিধায় সম্বোধন করে তাদের দুর্দশা বা তাদের রক্তঝরা সংগ্রামের কথা উলেখ করেছেন। এই ভাষণে তিনি জনগণের ওপর শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণ এবং এর প্রতিবাদে বাঙালিদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় তাঁর নিজের সুদীর্ঘ সংগ্রামী প্রচেষ্টার কথা অনবদ্যভাবে বর্ণনা করে স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। শুধু এই ভাষণই নয় বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনই প্রকৃতপক্ষে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল উৎসর্গীকৃত। একদিকে জনগণের সার্বভৌমত্বে আস্থাবান বাঙালি ও তাদের সমর্থকরা, অন্যদিকে অস্পষ্ট এবং অব্যাখ্যাত চেতনায় উদ্বুদ্ধ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকরা এক ব্যাপক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এই যুদ্ধ ছিল অনিবার্য। কারণ জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজ নৈতিক বৈধতা আসে না। সে হিসেবে একাত্তরে বঙ্গবন্ধু যে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন সেই যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থায় বৈধতা আনা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরিণতিতে খণ্ডিত ও বিকৃত চেতনায় তাড়িত পাকিস্তানি পক্ষ পরাজিত হয় এবং তাদের দৃষ্টিতে অসম্ভব ঘটনা বিংশ শতাব্দীতে ঘটে যায়। জনগণের সার্বভৌমত্বে আস্থাবান বাঙালি জয়লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও বঙ্গবন্ধু তখনো বন্দি ছিলেন পাকিস্তানি হায়েনাদের কারাগারে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ রাতে মুক্ত হন। মুক্তি পাওয়ার পরই তিনি যেতে চেয়েছেন সদ্য স্বাধীন দেশ তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে। কিন্তু জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সেটা সম্ভব ছিল না। সম্ভব ছিল না প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার করা। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে তৃতীয় দেশ হিসেবে ইরান অথবা তুরস্ককে বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু তা নাকচ করে দেন। এবং তাঁকে লন্ডন হয়ে পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। কারণ বাংলাদেশের পর সবচেয়ে বেশি বাঙালির বসবাস তখন ব্রিটেনে। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন লন্ডনকে। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী এই সংবাদ পাকিস্তান প্রচার করেনি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি নিজেই বিশ্বকে জানাতে চাই আমার মুক্তির বার্তা, বিজয়ের বার্তা, সার্বভৌমের বার্তা। বিশেষ বিমানে পরের দিন ভোরে লন্ডন পৌঁছেন। ৮ তারিখ সন্ধ্যায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বৈঠক করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। লন্ডন থেকে দেশে ফিরলেন দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি। দিল্লিতে স্বাধীনতার বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক সংবর্ধনায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রীপরিষদের অনেক সদস্য ও লাখো ভারতবাসী।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার সময় মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে অবস্থান করছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য এবং গৌরবোজ্জ্বল। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বঙ্গবন্ধু কখনও কার্পণ্য করেননি। তখন একটি গুজব খুব প্রচলিত ছিল যে, দেশ থেকে সোনা, রূপা, তামা, পীতলসহ তৈজসপত্র, গাড়ি ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিপুলাকারে সীমান্তের ওপারে চলে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এসব অভিযোগ শুনছিলেন। উভয় সংকটে পড়লেন তিনি কারণ এমনটা তো সার্বভৌমত্বের ওপর কঠিন আঘাত। ভারতীয় বাহিনীকে স্বদেশে ফেরানো কোন সহজ ব্যাপার ছিল না। বাস্তবতার সঙ্গে চক্ষুলজ্জা বলেও তো কথা। সরকারের ও দলের নেতারা বিচলিত, কীভাবে সেনাবাহিনী ফেরাবেন তা বোধগম্য হচ্ছিল না কারোরই। এমন অবস্থার মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কলকাতা সফরে যান। দমদম বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে সৈন্য ফিরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধুর কথায় ইন্দিরা গান্ধী এর কারণ জানতে চান। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র। পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতীয় সৈন্যরা থাকলে এই অপপ্রচার লোকজন বিশ্বাস করবে।’ এরপর ইন্দিরা গান্ধী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘আপনার আগামী জন্মদিনের আগেই ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নেয়া হবে। ১৭ মার্চ ছিলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ইন্দিরা গান্ধী মার্চে ঢাকায় এসেছিলেন। তার আগেই ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে নেয়া হয়। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকগুলো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে গুজব রটনাকারীদের অপচেষ্টার জবাব বঙ্গবন্ধু এ ভাবেই দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর এক ঝানু আমলা শ্রী ডি পি ধরকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেছিলেন, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন কাঠামো গঠনে সহায়তা করার জন্য। বিষয়টি স্পর্শকাতর ঠেকলো বঙ্গবন্ধুর কাছে। এখানকার প্রশাসনও ডি পি ধরের খবরদারি মানতে চাচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করতে গেলেন এক রাতে সমভিব্যাহারে। সৌজন্যমূলক কুশলাদি বিনিময়ের পরে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করেই বলে বসলেন, ‘মি. ধর, কবে দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন? এসেছেন মাত্র, কয়েকটা দিন আমাদের এখানে কাটান। বাংলাদেশ মাছের দেশ। এখানকার পদ্মার ইলিশ খুবই উপাদেয় ও মজাদার। কয়েকদিন থেকে মাছ-টাছ খান, তারপর যাবেন।’ ডি পি ধর হতবাক, প্রথম দিবসেই তাঁকে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেয়া হলো, কেন? সরকার প্রশাসন কাঠামো গঠনের কোন ইঙ্গিতও নেই। তাহলে?
রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর ওদিনই বার্তা পাঠালেন দিল্লিতে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যা বুঝার বুঝলেন। তিনি দ্রুত ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দিলেন মি. ধরকে। বঙ্গবন্ধু ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে এভাবে সরাসরি ডি পি ধরকে অপ্রস্তুত করে ফেলে দিল্লিতে ফেরানোর পথনির্দেশ দিতে পারতেন না। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের তেজ ছিল বঙ্গবন্ধুর মজ্জাগত। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রয়োজনে ভারতের সাহায্য নিয়েছি এবং তা কৃতজ্ঞচিত্তে সর্বদা স্বীকার করা হবে। কিন্তু সার্বভৗম বাংলাদেশ কারও আঙ্গুলি হেলানে পরিচালিত হবে না।
১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মুসলিম দেশসমূহের ইসলামিক সম্মেলনে যোগদান প্রশ্নে গণভবনে আয়োজিত বৈঠক বঙ্গবন্ধুর সরকারের একটি অংশ ‘না’ যাওয়ার পক্ষে মত দিল। তারা বলছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে ইসলামি সম্মেলনে যোগদান ঠিক হবে না। অপরপক্ষের যুক্তি ছিল যে, শতকরা ৯০ জন মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামিক সম্মেলনে না যাওয়া হবে দেশের মানুষের ধর্মানুভূতির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনেরই নামান্তর। বঙ্গবন্ধু যখন যাওয়ার পক্ষে মত দিতে চলেছিলেন, তখন ‘না’-পন্থীরা প্রস্তাব দিলেন, ইসলামাবাদের যাত্রাপথে দিল্লি সফর করে গেলে সবদিক রক্ষা হবে। বঙ্গবন্ধু তাদের সাথে সম্পূর্ণ দ্বি-মত পোষণ করলেন। তার মতামত ছিল, আমাদের দেশ সার্বভৌম। দেশের যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ ক্ষমতা এবং অধিকার রাষ্ট্রের। তিনি দ্ব্যর্থ কণ্ঠে সরাসরি ইসলামাবাদ যাবার ঘোষণা দেন।
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর এমন দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণেই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হয়ে দ্রুতই স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। পরবর্তীতে যা আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বিনির্মাণেও পালন করেছিল অগ্রণী ভূমিকা। পাশাপাশি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ কমনওয়েলথ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রভৃতির সদস্য হয়ে দেশের কূটনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করেছিলেন তার বাস্তবায়নের জন্যই কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। স্বাধীনতা পরবর্তী নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পাকিস্তানি বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারতে আশ্রয় নেয়া ১ কোটিরও বেশি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে আনা, নতুন সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালের মার্চে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে ভৌত অবকাঠামো পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসন করা, সমাজ উন্নয়নের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিতদের অর্থনৈতিক মুক্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র বাংলাদেশের সার্বভৗমত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিতই করেননি, সুনিশ্চিত করেছেন এ কথা অবলীলায় বলা যায়।
লেখক-এইচএমএ হক (বাপ্পি)
এমএইচআরডিআইআর (জাবি),
পিজিডি-এইচআরএম (বিআইএম),
বিবিএ, ইএমবিএ (ঢাবি),
এমএসএস (ঢাবি)।
Leave a Reply