সৈয়দ নুরুর রহমান :
জনপ্রতিনিধি শব্দটির সাথে আমাদের দেশের নাগরিকরা প্রায় প্রত্যেকে পরিচিত। এই জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্বের কারণে বিশেষ এলাকার জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেন, নিজ নিজ এলাকার মানুষদের সার্বিক কল্যাণে নিজেদের নিযুক্ত রাখেন। দেশের জনগণের রায় প্রকাশের মাধ্যমে তারা প্রতিনিধি নির্বাচিত হন বলেই জনস্বার্থ সংরক্ষণে তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণের সরাসরি ভোটে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। আবার নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে অবসান ঘটে সেই প্রতিনিধিত্বের। সমাজের ও রাষ্টের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তারা নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
মহামারি করোনা দুর্যোগের কঠিন এই দুঃসময়ে ঢালাওভাবে জনপ্রতিনিধিদের চরিত্র হননের অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল। অথচ দেশে আজ আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই একের পর এক করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
ত্রানের চাল চুরির বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একশ্রণীর মানুষ যেভাবে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের চরিত্র হননে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তা ছিল খুবই বেদনাদায়ক। কিন্তু কতজন জনপ্রতিনিধি এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত? কখনও কি ভেবেছি আমরা।
আমাদের দেশে ৬১ হাজার ৫৭৯ জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। তারা সরকারি ত্রাণ কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫৭১ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ৪১ হাজার ১৩৯ জন পুরুষ মেম্বার, ১৩ হাজার ৭১৩ জন মহিলা মেম্বার, ৪৯২ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ৯৮৪ জন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পুরুষ/মহিলা , ৩৩০ জন পৌর মেয়র ও ৩৫০ জন জাতীয় সংসদ সদস্য।
আর এই পর্যন্ত অর্ধশতাধিক জনপ্রতিনিধিকে দুস্থ অসহায় মানুষের রিলিফের চাল চুরির জন্য হাতেনাতে ধরা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর দিকনির্দেশনা ও মনোভাবের কারনে সরকারই এসকল চোর জনপ্রতিনিধিদের ধরেছে, মামলা করেছে, জেল হাজতে পাঠিয়েছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাদেরকে পদ থেকে বরখাস্ত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি দিয়ে বারবার বলেছেন, ‘এই সময়ে অনিয়ম করলে কাউকেই ছাড়া হবে না, সে যেই হোক।’ সেই অনুযায়ীই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মুলত এক শ্রেণীর জনপ্রতিনিধি যারা জনগণের রায়, ভোটকে চুরি করেছে, ভোটে দেদার অর্থ ব্যয় করে জনতার রায় কিনে নিয়েছে তারাই গদীতে বসে জনগণের অধিকার হরন করেছে। টেন্ডার, কাবিখা মেরে খেয়েছে। তাদের কাছে জনগণ কিছুই না।
সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের দ্বারা জনপ্রতিনিধিদের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হলেও অসৎ জনপ্রতিনিধিরা তা থোড়াই তোয়াক্কা করেন। নির্বাচনে জয়লাভের যুক্তিতে তারা ক্ষমতা করায়ত্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেন, আত্ম-অহংকারে বলীয়ান হয়ে ওঠেন এবং আচরণ শুরু করেন সামন্ত প্রভুদের মতো। দুর্বৃত্তপরায়ন এসকল জনপ্রতিনিধির কাছে জনসেবার চেয়ে আত্ম-স্বার্থ সেবা বড় হয়ে দেখা দেয়। এদের অনেকেই এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন যা ছিল সত্যিকার অর্থেই ক্ষমার অযোগ্য। এদের কাউকেই ছাড় দেয়া হয়নি।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ত্রাণসহ অন্যান্য সরকারি সুবিধা আত্মসাতের অভিযোগে দেশজুড়ে এ পর্যন্ত অনেকগুলো মামলা দায়ের করেছে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান্য ইকবাল মাহমুদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, সরকারের ত্রাণ আত্মসাতে যাকেই সম্পৃক্ত পাওয়া যাবে, তাকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। আত্মসাতের সাথে সম্পৃক্ত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
কিন্তু এরপরও আমাদের জনপ্রতিনিধিদের চরিত্রহননের মহোৎসবকালে আমরা স্রোতে গা ভাসিয়েছি। যথেচ্ছ বাজে মন্তব্য করেছি। মাত্র ৪০-৫০ জন অসৎ চরিত্রের জনপ্রতিনিধির জন্য গণহারে সব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ইমেজ নষ্ট করা হয়েছে।
সব শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যেই খারাপ লোক থাকে। এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। দেশে এমন কেউ আছেন যে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, তাদের পেশায় সবাই ভালো মানুষ। গুটি কয়েকজনের দায়ভার কেন সবার কাধে তুলে দেব?
সাম্প্রতিক সময়ে জীবনবাজি রেখে যারা বিপদগ্রস্থ অসহায় দুস্থ মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে গেছেন ত্রাণ দেয়ার জন্য, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় কি অবলীলায় আমরা তাদের সমালোচনা মুখর হয়েছি। অথচ আজ তারাই মৃত্যুমুখে পতিত।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একজন মন্ত্রীসহ মোট ছয়জন সংসদ সদস্য করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। তারা হলেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিরাজগঞ্জ-১ আসনের মোহাম্মদ নাসিম, বান্দরবানের এমপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ এর এবাদুল করিম বুলবুল, জামালপুর-২ এর ফরিদুল হক খান, চট্টগ্রাম-১৬ এর মোস্তফিজুর রহমান চৌধুরী এবং নওগাঁ-২ এর সংসদ সদস্য শহীদুজ্জমান সরকার।
শুধুমাত্র আমাদের কুমিল্লায় ১০জন জনপ্রতিনিধি করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। সারা দেশে এ সংখ্যও পাঁচ শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে।
কুমিল্লা জেলায় এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন, কুমিল্লা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এড. আমিনুল ইসলাম টুটুল, দাউদকান্দি পৌরসভার মেয়র নাঈম ইউসুফ সেইন, চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান, লাকসাম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মোহাব্বত আলী, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের দুই জনপ্রিয় কাউন্সিলর ২১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহবুব ও ২৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসান, চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুল ইসলাম, ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম, মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়নের বিল্লাল মেম্বার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এরা সবাই করোনাকালে মানুষের পাশে দাড়ানোর জন্য দিনরাত নিজ নিজ এলাকায় ছুটে বেড়িয়েছেন। করোনা সংকট মোকাবেলায় মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে তাদের লড়াই ছিল নিরন্তর। করোনা ভয় উড়িয়ে দিয়ে আন্তরিক প্রত্যয় নিয়ে শুরু থেকেই আমাদের এসকল জনপ্রতিনিধিরা মাঠে তৎপর ছিলেন। দুস্থ গরীব মানুষের তালিকা তৈরি করেছেন, এান কাজ সমন্বয় করছেন। ছুটে গেছেন দুস্থ অসহায় মানুষের বাড়ি বাড়ি। আজ তারাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে লড়ছেন অদৃশ্য ভাইরাস শক্তির বিরুদ্ধে।
জনপ্রতিনিধিদের ঢালাও সমালোচনার জোয়ারের সময় অনেক জনপ্রতিনিধি ফোন করে তাদের মনোবেদনার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন দিনরাত কাজ করে আজ গুটিকয়েক অসৎ ব্যক্তির দায়ভার সব জনপ্রতিনিধির কাধে উঠিয়ে দেয়ার যে অপচেষ্টা শুরু হয়েছে, তা সত্যিই ভয়ংকর। কাজের মনোবল হারিয়ে ফেলছে অনেকে। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।
যে হারে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কঠিন সমালোচনা হয়েছে, আজ তারাই একের পর এক করোনা আক্রান্ত হলেও এখন দেশের মিডিয়া আশ্চার্যজনকভাবে নিরব। নেগেটিভ সংবাদ পরিবেশনায় আমরা যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি তা বোধহয় আমাদের অস্থিমজ্জায় শিকড় গেড়ে বসেছে।
আমাদের দেশে এমন অনেক জনপ্রতিনিধি আছেন, যারা সরকারী অনুদানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পদের অনুদান নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সর্বস্ব দিয়ে তারা জনগণের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। এ কারনে তাদেরকে জনগণ শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, বিশ্বাস করে।
তাই আসুন, ঢালাওভাবে জনপ্রতিনিধিদের চরিত্রহনন না করে তাদের জনবান্ধব কর্মপ্রয়াসকে মুল্যায়ন করি।
Leave a Reply