মোজাম্মেল হক আলম :
সুখি-সুন্দর ও শিক্ষত পরিবারের বড় ছেলে। মা-বাবার স্নেহমাখা, আদর, ভালবাসায় বেড়ে ওঠা আমার। ৭ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ার কারনে, মা-বাবার আদর, ভালবাসা অন্য ভাই-বোনদের তুলনায় একটু বেশীই পেয়েছি। মা-বাবার কাছে থেকে যখন যা চেয়েছি, তারা তাদের সাধ্যমতো ছেলে মেয়ের আবদার পূরনের চেষ্টা করছেন। আমার মা পেশায় একজন আদর্শ গৃহিনী এবং একজন শিক্ষিত মানুষ। তিনি তৎকালীন আমলে সফলতার সহিত মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেছেন। শুনেছি পরবর্তীতে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর উপরে লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি।
বাবা ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন দক্ষ কর্মকর্তা। শুনেছি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ২২ বছরের যুবক আমার বাবা সিরাজ মিয়ার সম্যক পারদর্শীতায় মুগ্ধ হন কমান্ডাররা। যার ফলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই তারা বাবাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেন। রাস্ট্রীয় কর্মকর্তা হিসেবে বাবার ব্যস্ততার কারণে আর মা শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে লেখাপড়ার হাতেখড়ি আমার মায়ের হাতেই হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই মা আমাদের সকাল এবং বিকালে নিয়ম করে পড়াতেন। আজ আমি যেখানে এসেছি সবটুকু মায়ের অবদানের কারনেই। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি, আমার মা কিভাবে সংসার, স্বামী, ছেলেমেয়েকে পাখির ডানার মতো আগলে রেখেছেন। পরিবারে বাবাকে খুব বেশি ভয় পেতাম। যা এখনো পাই। কিন্তু মাকে আমরা ভয় পেতাম না। মা ছিলেন আমাদের কাছে বন্ধুর মতো, দুধভাতের মতো। শৈশব থেকেই দেখে আসছি আমাদের কোন অসুখ হলে তিনি কতটা অস্থির হয়ে যেতেন। বাবাকে তাড়া দিতেন ছেলের ওষুধ আনার জন্য, আর মা পাশে বসে থাকতেন। মাথায় হাত রেখে বারবার বলতেন, চিন্তা করো না, এইতো জ্বর সেরে যাবে। তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? আমার মা কোনো চাকরি করতেন না। কিন্তু কখনো কোনোকিছু মায়ের কাছে চাইলে, তিনি সহজে নিরাশ করতেন না। আমাদের যখন যা প্রয়োজন ছিলো মা যেনো কেমন করে সেটা ব্যবস্থা করে দিতেন। আমাদের শুধু বলতেন, তোমাদের ভালভাবে লেখাপড়া করতে হবে। দীর্ঘ ১৫বছর সেনাবাহিনীর চাকুরী শেষে বাবাও বাড়িতে এসে হাল ধরলেন সংসারের। সুন্দরভাবেই চলছিলো আমাদের জীবন।
কিন্তু হঠাৎ করে কয়েকটা ঝড় এসে এলোমেলো করে দিল আমাদের জীবন। মা হয়ে উঠলেন আমাদের জন্য কঠোর শাসনকর্তা। আমরাও মায়ের অনুভূতি না বুঝে চলে গেলাম দূরে। আর সেখান থেকেই দূরত্ব বাড়লো আরো বেশী। আমাদের এই দূরত্বের সুযোগ বুঝে অন্য কেউ এসে সুন্দর এই পরিবারটাকে ভাগ করে দিল দু’ভাগে। দিনদিন আমাদের মাঝে বাড়তে থাকলো দূরত্ব। আজ আমরা মা-বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে দিন কাটাচ্ছি কষ্টে। নিজের সংগ্রামী জীবনের অর্জিত সকল সুখগুলোই দিয়েছি পুরো পরিবারের জন্য। কখনো নিজে বড় হতে হবে, সেটা কল্পনাও করিনি। ভেবেছি শুধু ভাই-বোন আর তাদের সন্তানদের কথা। তারপরও কেন অবহেলার পাত্র হয়ে গেলাম জানিনা। হয়তো কোন ভুল ছিলো আমাদের, যা জানা ছিলোনা।
মাঝেমাঝে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। মা-বাবার আদরের সন্তান হয়েও কিছু ভুল বুঝাবুঝির কারণে কেন এই দূরত্ব। আর পরিবারের কয়েকজনই বা কেন এত উগ্র। ভালোবাসাতো উগ্রতা দিয়ে হয়না, ভালোবাসা হয় পুরো পরিবারের মেলবন্ধনে। ভুল যদি কিছু থেকে থাকে সেখানে তা নিরসনের পথও রয়েছে। তাও ঠিক নিরসন হবেই বা কিভাবে? কোন সমস্যার মধ্যখানে যদি বিষাক্ত কিছু প্রবেশ করে তা হলে তা আরো বিষাক্ত হয়ে উঠে পারিবারিক মেলবন্ধ। তবুও কারো প্রতি কোন অভিযোগ বা প্রতিক্রিয়া নেই। আর কার জন্যই বা অভিযোগ করবো? এটাতো কোন কালেই সম্ভব নয়। তারপরও চাইবো মহান সৃষ্টিকর্তা যেন আমাদেরকে মিলেমিশে সুন্দরভাবে বাঁচার তৌফিক দান করেন। মা-বাবা যেখানেই থাকুক, তাদেরকে তুমি ভাল রেখো। আমি যেনো তাদের যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পারি। মা-বাবার মুখে যেনো হাসি ফোটাতে পারি। ভালো থাকুক সমস্ত মমতাময়ী মায়েরা, মা-বাবার যোগ্য সন্তান হয়ে উঠুক ছেলে-মেয়েরা।
লেখক :
সাংবাদিক
Leave a Reply