রফিকুল রঞ্জু
কবিতা বিষয়টা ঠিকঠাক বুঝি না। তবে কবি জিনিসটা বুঝি। কাব্য বলতে কী বোঝায় তা-ও একটু বুঝি। শব্দটা যেহেতু কব্য থেকে তৈরি তাই বুঝতে পারি এর মধ্যে কবার (কথা) জিনিস আছে। মানে কেউ কোনো বিষয়ে কিছু কয়েছেন। আমরা তো অহরহই কই- একটা মুখ তো কথা কম কবা! সোজা কথায়, এটি কব্ ক্রিয়া থেকে তৈরি। কাব্য তাই পন্ডিতদের কথার সম্ভার। জ্ঞানফলের বৃক্ষ।
কবি-ও কব্ থেকে তৈরি। কব্ মানে কথার মধ্য দিয়ে কোনোকিছু বর্ণনা করা। বক বক করাও বলি আমরা। তার মানে দাঁড়ায়, যিনি ‘কব্’ কাজটি করেন বা যিনি বক বক করেন তিনি কবি। অবশ্য এখনকার অভিধানে কবি শব্দের অর্থ দেয়া আছে- কবিতা-রচয়িতা, পণ্ডিত, তত্ত্বজ্ঞ ইত্যাদি। কিন্তু পুরানা অভিধানে পাওয়া যায়, কবকারীকে কবি বলে।
হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের প্রণয়ন করা অভিধান বঙ্গীয় শব্দকোষ খুললে দেখা যায়- কবি : কব্ (বর্ণন)+ ই (ইন্)। সেখানে কবির আরও একটি ব্যুৎপত্তি তিনি উল্লেখ করেছেন। সেটার কারণে আমার মাথায় কিছু চাপও পড়েছে- কবি : কু (শব্দ/আওয়াজ/ডাক)+ ই +ক! মানে যিনি কু শব্দ করেন, কু কথা বলেন তিনিও কবি!
মানে, সুকথা বলেন যিনি তিনি যেমন কবি, কুকথা বলেন যিনি তিনিও কবি। কবিরা যে কবিরা গুনাহও করেন সেকথা আমাদের পূর্বতন পণ্ডিতরা ভালো করেই জানতেন!
গুনাহ কী করে হয়? যখন কেউ নিয়মের বাইরে কথা বা কাজ করে তখনই তো গুনাহ হয়? সরল করে বললে, কিছু কবি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নিয়ম মেনে কব্ করেন বা কাব্য করেন। আর কিছু কবি সমাজের নিয়ম ভেঙ্গে কু আওয়াজ তোলেন, গুনাহ করেন।
এক দল প্রচলিতকে রক্ষা করে চলেন। সেটার সংখ্যাই বেশি। কারণ তাতে সমাজ-রাষ্ট্রের স্নেহ পাওয়া যায়। আর একথা তো সবারই জানা যে, রাজার স্নেহ না পেলে সাধারণত কোনো কবি বড় কবি হিসেবে পরিচিত হন না!
আর বিপরীতে গুনাহকারী মানেই দণ্ড আর মুণ্ড নিয়ে সদা ভয়। সাথে সামাজিকভাবে অবমাননা, নিগ্রহ তো থাকবেই। তাই কু ডাক দেন যে কবি, তাকে শুধু লেখালেখির জগতেই নয়, লড়াই করতে হয় বাস্তব জগতের সাথেও। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তাকে কবি হয়ে উঠতে হয়।
সুকথার কবিদের সেই লড়াই নেই। তবে তাদের মধ্যেও লড়াই থাকে- নিজেদের মধ্যে অহংকারের লড়াই। এইখানে এসে মনে হয়, সুকথাই তো দেখি খারাপ? সুকথার কবিরা তাহলে এ-ই?
দর্শনের দিক থেকে দেখলে প্রকৃতি, পুরুষ দুটো ছাড়া তো দুনিয়া চলতে পারে না। আধার লাগবে, আধেয়-ও লাগবে। পুরুষ লাগবে, স্ত্রীও লাগবে। নতুন নতুন আবিষ্কার, উদ্ভাবন লাগবে। আবার সেইগুলোকে বহন করার বা বিস্তৃত করার কাজও লাগবে।
দর্শনের এই বিচারে কাব্যেরও স্ত্রী, পুরুষ আছে। স্ত্রীরা প্রচলিতকে ধারণ-রক্ষণ করে চলেন। আর কু-ডাক দেয়া গুনাহকারী পুরুষরা নতুন কিছু নির্মাণ করে চলেন। তাই দেহ দেখে কবির লিঙ্গ নির্ণয় স্বভাবতই হবে ত্রুটিপূর্ণ!
আবারে এভাবে ভাবলে দেখা যাচ্ছে, শুধু পদ্য লিখলেই কবি হয় না। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া ইত্যাদির লিখিয়েরাও কবি।
নাহিদ হাসান প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ভেঙেচুরে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মাঠে লড়াই করেন। তিনি প্রচলিতের ধারক-বাহক নন। বিচার করলে তার লেখালেখি তাই হয়ে দাঁড়ায় গুনাহ। তার কথাগুলো সামাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে মনে হয় কু-কথা, কু-ডাক। তার কবিতার প্রথম বই- ‘বড় আপা, ক্রসফায়ার ও অন্যান্য’। বইয়ের নামের মাঝেই একটা কুডাক। আমি এই কু-ডাক দেয়া কবিদেরই বেশি পছন্দ করি।
ওর কবিতা পড়েছি অনেক পড়ে। কিন্তু শুনেছি প্রায় তিরিশ বছর আগে! এক জনসভায়। বাঘা সিদ্দিকীর কণ্ঠে। ওর কবিতা পড়ে বক্তব্য শুরু করেছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। বঙ্গবীরকে নিয়ে তখন অনেক গল্প শুনেছিলাম, যেন রূপকথার মতো। তাকে দেখার ইচ্ছে নিয়ে বালক আমি গিয়েছিলাম জনসভাস্থলে। দূর থেকে আবছা দেখতে পেয়েছিলাম। তবে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলাম নলেজের কবিতা। নলেজ হলো নাহিদ হাসানের ডাকনাম। প্রথমে নামটাই খটকা লেগেছিল, এটা আবার মানুষের নাম হয় নাকি? পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সে আমাদেরই বয়সী। আসলেই তার নাম নলেজ। আমাদের দেখা হয়েছিল আরও অনেক পরে। তবে এর মাঝে তার আরও কবিতা আমার পড়া হয়েছিল- স্কুলের দেয়ালিকায়।
তাকে খোঁজার চেষ্টা করি, বোঝার চেষ্টা করি। একসময় অনুধাবন করি, নাহিদ হাসান শুধু কাগজের কবি নয়, কাজেরও কবি। শুধু পটের কবি নয়, ঘটেরও কবি। কিন্তু আমরা, আর বাকিরা ঘটটা, মাঠটা দুটোই বন্ধক দিয়ে বসে আছি।
Leave a Reply