মাসুদুর রহমান, লাকসাম।।
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে আতাউর রহমান (৩৮) নামক এক যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। আতাউর রহমান উপজেলার বিপুলাসার ইউনিয়নের সাইকচাইল গ্রামের উত্তরপাড়ার জুনাব আলীর ছেলে। গত শুক্রবার (২৪ জুলাই) সকাল ৯টায় সাইকচাইল গ্রাম থেকে গাছের ডালে রশিতে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের পরিবারের দাবি এটি পরিকল্পিত হত্যা। অপর একটি হত্যা মামলার কার্যক্রম স্থগিত করতেই তাকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা দাবি করেন। পারিবারিক সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে আতাউর রহমান তার ফুফাতো ভাই রিপনের সাথে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোনাইমুড়ী উপজেলার চাষীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিনের সাথে শ্যালিকার হত্যা মামলা সংক্রান্ত আলাপ করতে যান। এরপর থেকে তিনি বাড়ি ফিরেননি। রাতে বেশ কয়েকবার পরিবারের সদস্যরা তাকে কল দিয়ে ফোন বন্ধ পায়। পরদিন শুক্রবার সকালে প্রতিবেশীরা আতাউর রহমানের মরদেহ বাড়ির পার্শ্ববর্তী মৎস্য প্রজেক্টের পাড়ে গাছের ডালে রশিতে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। খবর পেয়ে নাথেরপেটুয়া পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক মো. নুরুল আলম ঘটনাস্থলে গিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করে। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত না হতে পারায় মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়। ময়নাতদন্তের পর শুক্রবার রাতে জানাযার নামাজ শেষে নিজ গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এদিকে ৩ সন্তানের জনক আতাউর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা জানান, তার পারিবারিক কোনো বিরোধ ছিলো না এবং তিনি কোনো প্রকার মানসিক অশান্তিতেও ছিলেন না যে আত্মহত্যা করবেন। তাছাড়া তার পায়ে সমস্যা থাকার কারণে তিনি গাছে উঠতে পারতেন না। তাকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে তারা দাবি করেন। আতাউর রহমানের আকস্মিক মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনের জন্য তারা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন। নিহত আতাউর রহমানের ভাই নুরুর রহমান জানান, গত বুধবার (২২ জুলাই) আতাউর রহমান নোয়াখালির সোনাইমুড়ী উপজেলার আলোকপাড়া তার শ্বশুর বাড়িতে যান। সেখান থেকে তিনি শ্যালিকার হত্যা মামলা সংক্রান্ত কাজে কুমিল্লার আদালতেও যান। তার শ্যালিকা বকুল আক্তার মনোহরগঞ্জ উপজেলার নারারপাড় গ্রামের শাজাহানের ছেলে বাহরাইন প্রবাসী আব্দুর রহিমের স্ত্রী ছিলেন। ২০১২ সালে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন করতো। গত ২২ মার্চ শনিবার শ্বশুর বাড়ি থেকে বকুল আক্তার ও তার শিশুকন্যা ফাতেমা আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদেরকে মুখে বিষ ঢেলে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে তার মা ছেমনা বেগম বাদি হয়ে মনোহরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। গত কয়েক মাস ধরে এ হত্যা মামলা পরিচালনায় বকুলের পরিবারকে সহযোগিতা করে আসছিলেন তার ভগ্নিপতি আতাউর রহমান। মামলা দেখাশুনা না করতে চাষীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বিভিন্ন ভাবে আতাউর রহমানকে চাপ প্রয়োগ করেন। গত কয়েকদিন ধরে মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে উভয় পক্ষের মাঝে কথাবার্তা চলছিলো। বকুলের শ্বশুরবাড়ির লোকজন বকুলের পরিবারকে মামলা নিষ্পত্তির বিনিময়ে ১৪ লাখ টাকা দেয়ার প্রস্তাব করেছিলো। এ প্রস্তাবের পর তারা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিনের কাছে নগদ ২ লাখ টাকা এবং বাকি ১২ লাখ টাকার চেক দেন। ২ লাখ টাকার মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির জন্য চেয়ারম্যান ১ লাখ টাকা দেন বকুলের ভগ্নিপতি আতাউর রহমানের কাছে। আতাউর রহমান মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন খাতে ৭৫ হাজার টাকা খরচ করেন। এর মধ্যে আতাউর রহমানের ফুফাতো ভাই রিপন তার কাছে বাকি ১২ লাখ টাকা থেকে ২ লাখ টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে তাদের দুজনের মাঝে বাকবিতন্ডাও হয়। গত বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) ১২ লাখ টাকার চেক নিতে ফুফাতো ভাই রিপনকে দিয়ে আতাউর রহমানকে চাষীরহাট ডাকেন চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন। ২৫ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে রিপনের সাথে মোটরসাইকেল যোগে তিনি চাষীরহাট যান। এরপর থেকে তিনি আর বাড়ি ফিরেননি। পরদিন বাড়ির পাশে তার ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়। আতাউর রহমানের ভাই নুরুর রহমানসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দাবি করেন, বকুল হত্যা মামলার কার্যক্রম স্থগিত করতেই ফুফাতো ভাই রিপন, এবং চাষীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিনের সহযোগিতায় আতাউর রহমানকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করেছে বকুলের শ্বশুর বাড়ির লোকজন। তারা এ হত্যাকান্ডে জড়িতদেরকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত রিপন অভিযোগ অস্বীকার করেন। এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান (চাষীরহাট ইউপি) কামাল উদ্দিন বলেন, ‘বকুল আমার ইউনিয়নের মেয়ে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমিও বকুল হত্যার বিচার চাই। মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে কথা বলতে বকুলের ভগ্নিপতি আতাউর রহমান বেশ কয়েকবার আমার কাছে এসেছিলো। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি আমার কাছে আসেন এবং কথাবার্তা শেষে রাত সাড়ে ৯টায় বিদায় নেন। তবে তিনি কি কারণে আত্মহত্যা করেছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। হয়তো আমার প্রতিপক্ষদের প্ররোচনায় নিহতের পরিবার আমাকে এ ঘটনায় জড়াচ্ছে। আমি আশা করছি, প্রশাসনের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আতাউর রহমানের মৃত্যুর সঠিক কারণ এবং রহস্য উন্মোচন হবে।’ মনোহরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে আতাউর রহমানের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। এটি হত্যাকান্ড হলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
Leave a Reply