নাজমুল হাসান :
( লেখকের ফেসবুক থেকে গৃহীত )
একজন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের অসাম্প্রদায়িক হবার পথে কোন বাঁধা নেই বলেই আমার মত। আমিও নিজেকে এই গোত্রের মানুষ বলে মনে করি।
আমার কাছে অসাম্প্রদায়িকতা (Cosmopolitanism) একটা আদর্শিক অবস্থান যেখানে সকলের পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার আত্তীকরণ হবে। যেখানে নিজ বিশ্বাসের পাশাপাশি অন্যের পবিত্র বিশ্বাসের প্রতি একটা উদার ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। কোন প্রিজুডিস থাকবে না।
অনেকটা অন্যের জুতো পায়ে দিয়ে তাঁর কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতি কিংবা অনুভূতিকে দেখার/বুঝার এক নির্মোহ প্রয়াস! এক শুভ ও মানবিক চেতনা, যেখানে থাকবে সমানুভূতি ও নায্যতা।
অসাম্প্রদায়িকতা কখনো কোন ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোকে সমর্থন করে না। সভ্য মানুষের উগ্র ধর্মান্ধ কিংবা কপট হবার কথা ছিলো না!
অথচ এই সভ্য জগৎ জুড়েই কোথাও পরোক্ষভাবে কোথাও প্রত্যক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কপটতার বিষ বাষ্প। প্রতিক্রিয়াশীল/রক্ষণশীল গোষ্ঠীর জয়জয়কার দেখা যাচ্ছে।
আছে পশ্চিমা উদারতার নামে কপটতা, আবার আছে ধর্মীয় রাজনীতির নামে পুঁজিবাদী ব্যাবসা! পূর্ব হোক আর পশ্চিম যেন ঘুরে ফিরে বটতল! এই মুহুর্তে ফ্রান্স কিংবা তুরষ্ক যা করছে তাও পলিটিকাল স্ট্যান্টবাজির অংশ ছাড়া কিছুই নয়।
ফ্রান্স এবং ইতালিতে দেখেছি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ওয়েস্টার্ন হিপোক্রেসি। ফরাসী ম্যাগাজিন শার্লি এবদো প্রায় সকল ধর্ম নিয়েই অবমাননাকর চিত্র প্রকাশ করে। যদিও সেক্যুলার ফ্রান্স সেকুলারিজম বলতে সবসময়ই বুঝিয়েছে ” ধর্মের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়ভাবে ধর্মীয় কর্মকান্ড প্রদর্শন না করা”। কিন্তু সেক্যুলারিজমের নামে অযৌক্তিক ধর্মীয় অবমাননা যেন ইদানীং সেক্যুলারিজমের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফ্রান্সের একটি ফ্যাশন হাউস লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির লাস্ট সাপার চিত্রটি ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে প্রকাশ করে যিশু খ্রিস্টকে অবমাননা করায় ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ উঠেছিলো কয়েক বছর আগে। এর প্রেক্ষিতে ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চের অভিযোগে এই ছবি প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো ফ্রান্সের একটি আদালত। আদালত এটিকে “অযৌক্তিক ও আক্রমণাত্নক” আচরণ আখ্যা দিয়ে বলেছিলো এটি খ্রিষ্টান ধর্মের মূল বিশ্বাসে অনধিকার আঘাত হেনেছে। অন্যদিকে এই ছবি নিষিদ্ধ হয়েছিলো মিলান সহ ইউরোপ, আমেরিকার অন্যান্য শহরে।
পক্ষান্তরে, শার্লি এবদো কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর অবমাননাকর কার্টুন এর বিষয়ে নিশ্চুপ ছিলো ফ্রান্সের একই আদালত! তাই, ফ্রান্স ও ইতালির ধর্মীয় বিষয়ে বাক স্বাধীনতার যৌক্তিকতা বিষয়ে দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং তখনো প্রশ্ন তুলেছিল ভারত ভিত্তিক ইংরেজি পত্রিকা দ্যা ইকোনমিক টাইমস! আমরা দেখেছি জার্মানি, ফ্রান্সের মতো তথাকথিত উদার রাষ্ট্রে আছে ব্লাসফেমি কিংবা এন্টি সেমিটিক স্পিচের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত আইনের কঠোরতা। অথচ অন্যদের বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি! নিজ ধর্মের ক্ষেত্রে এই দ্বিচারিতা, এই কপটতাও কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অনন্য রূপ। এই ওয়েস্টার্ন হিপোক্রেসি শুধু ধর্মীয় বিষয়েই নয় এটা গণতন্ত্র নিয়েও দারুণ সক্রিয়!
মূলত, স্বজাতিকেন্দ্রীকতার (Ethnocentrism) অসুস্থ আবেগ থেকে বের হয়ে “মাটির পৃথিবীর সকল মানুষ এক অভিন্ন প্রজাতির” মনে করে সমান জ্ঞানে সকলকে সম্মান করার শুভ মানসিকতার অভাব সর্বত্রই সুস্পষ্ট।
প্রকৃত মানবিকবোধ, উদারতা থাকলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি লিঙ্গ, বর্ণ- শ্রেণি ভিত্তিক বৈষম্য/সাম্প্রদায়িকতা এমনকি আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ কমে যেতো! ধর্ম নিয়ে হিংসা ছড়িয়ে অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো আত্নঘাতী ও সংকীর্ণ মানসিকতার জন্ম হতো না।
সাম্প্রদায়িকতার অনেক রূপ রয়েছে।
মূর্তি ভাঙা, মসজিদ- মন্দির, গির্জা- প্যাগোডায় হামলা আর ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকা একই সূত্রে গাঁথা। নিজ বিশ্বাস অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া, আবার অন্য ধর্মকে হেয় করা; প্রতুত্তরে সহিংস পথ অবলম্বন করা এসব কিছুই মানবিকতার পথকে, কল্যাণের পথকে রুদ্ধ করে। এগুলো ধর্মের কথা নয়!
মানুষ যদি নিজ অন্তরাত্মাকে না চেনে, অন্য ধর্মকে সম্মান করতে না শিখে, নিজেকে “সর্বশ্রেষ্ঠ” প্রমাণের জন্য ব্যস্ত থাকে ,তাহলে সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে না।
ভিন্ন মতের হলেই হেয় করা কিংবা প্রতুত্তরে হত্যা করা দুটোই উগ্রপন্থা!উগ্রপন্থা দিয়ে উগ্রপন্থাকে দমন করা যায় না! এরা প্রত্যেকেই প্রতিক্রিয়াশীল ও বর্বর সাম্প্রদায়িক।
একইভাবে, বাক স্বাধীনতার নামে যে কোন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানাও হিপোক্রেসি। বাক স্বাধীনতার অর্থ কখনোই অন্যের অনুভূতিকে আঘাত করার মতো বিষয় নয় বলেই আমার ধারণা। যার যার বিশ্বাস তাঁর কাছেই থাকুক। নিজের বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসকে শক্ত ভিঁত দেয়ার জন্যে অন্যের বিশ্বাসে/অনুভূতিতে আঘাত করা অযৌক্তিক ও অসভ্যতা!
এটা নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িকতার ডিসকোর্স! সতত সর্বত্র ধর্মকে আমরা মানুষেরাই জটিল করে তুলছি।
অথচ জীবনানন্দ বলেছিলেন, “সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!!”
লেখক :
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কুমিল্লা।
Leave a Reply