এ কে এম শাহনাওয়াজ :
প্রায় তিন দশক আগের কথা। ১৯৯১ সালের জুন মাস। আমি কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে অবস্থিত ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ’-এর লাইব্রেরি ব্যবহার করেছিলাম কিছুদিন। লাইব্রেরিতে বই দেওয়া-নেওয়ার দায়িত্বে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক ছিলেন। এত দিনে তাঁর নামটা ভুলে গেছি। ধরে নিচ্ছি, তিনি বিনয়বাবু। বিনয়ের অবতার ছিলেন। আমার সঙ্গে টুকটাক গল্প হতো। বাংলাদেশের মানুষের বাংলা ভাষাপ্রীতি তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। সেই তুলনায় তাঁর ততটাই ক্ষোভ কলকাতার বাঙালিদের প্রতি। তাঁর বিচারে বাংলা ভাষা তেমন মর্যাদা পাচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দপ্তরের যে বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে, তাতে বিনয়বাবুর ঘোর আপত্তি। একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। সেই স্মৃতিচারণা করে প্রায়ই বলতেন, আহা! কী চমৎকার বাংলা আপনাদের, জেব্রাক্রসিংকে লিখেছেন ‘পথচারী পারাপার’। পুরো সত্তায় গর্বিত বাঙালি বিনয়বাবু স্বগতোক্তি করে বলতেন, ‘দাদা, বাংলা ভাষা মর্যাদা নিয়ে বিশ্বদরবারে টিকে থাকবে শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের জন্য।’ বিনয়বাবুর এ ধারার কথা শুনতে সংগত কারণেই আমার ভালো লাগত।
২০১১-র ডিসেম্বরের একটি খণ্ডচিত্র। ঢাকায় এসেছেন কলকাতার একজন সমাজকর্মী ও গবেষক। আমাদের বন্ধু মনোতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতায় বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা যায় না, তাই ঢাকায় এসে আশ মিটিয়ে আমাদের বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখেছেন। মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাঁর। অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু তাঁকে মুগ্ধ করেছে। তবে মেনে নিতে পারেননি বায়ান্নস্নাত বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে বাংলা ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশের প্রবণতা। মনোতোষদা বললেন, যখন কলেজে পড়তেন সেই তরুণ বয়স থেকে তাঁরা কলকাতায় একুশের প্রভাতে প্রভাতফেরি করে আসছেন। হিন্দি ও ইংরেজি ব্যবহারের গ্রাস থেকে তাঁরা মুক্তি চান। এ কারণে একুশ তাঁদের প্রেরণা। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁদের অপার ভক্তি। সেই মনোতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। বললেন, আপনাদের চ্যানেলে কেন আমরা প্রমিত বাংলা শুনব না। যে দেশে একুশে ফেব্রুয়ারির জন্ম হয়েছে সে দেশে তরুণদের জন্য নির্মিত অনুষ্ঠানে ইংরেজি-বাংলার মিশেল শব্দে স্মার্ট হওয়ার প্রবণতা কেন? ‘প্রিয় দর্শকে’র মতো সুন্দর শব্দ থাকতে উপস্থাপক-উপস্থাপিকা কেন ‘ভিউয়ার্স’ বলে সম্বোধন করেন?
এমনি করে ২০ বছরের মধ্যে দুজন ভারতীয় বাঙালি দুই ভাবে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে মন্তব্য করলেন। আমি মনে করি, দুটি মন্তব্যই যথার্থ ও অন্তর্ভেদী। এ সময়ে বাংলা ভাষার প্রতি যে অবজ্ঞার প্রকাশ আমার কাছে অনেক ক্ষেত্রে তা কৃত্রিম বলে মনে হয়। এক ধরনের মানসিক দীনতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাণিজ্যচিন্তায় বাংলা ভাষাকে লাঞ্ছিত করতে আমরা দ্বিধা করি না। শহরকেন্দ্রিক এক শ্রেণির শিক্ষিত পরিবার বুঝে না বুঝে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে গিয়ে ছেলে বা মেয়েটিকে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার জায়গা তৈরি হতে দিচ্ছেন না। পুরো একটি লাইন বাংলায় বলা এদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।
একসময় প্রয়াত সরদার ফজলুল করিম স্যার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে আসতেন। একদিন শিক্ষক লাউঞ্জে স্যারকে প্রশ্ন করলাম, এখন স্বল্পশিক্ষিত অথবা শিক্ষিত ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত অনেকেই ছেলে-মেয়ের বিয়েতে ইংরেজি ভাষায় নিমন্ত্রণপত্র লেখেন কেন? যত দূর দেখেছি সরদার স্যার মানুষকে কষ্ট দিয়ে কোনো কথা বলেন না। স্যার স্বভাবসুলভ মৃদু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললেন, এ হচ্ছে শ্রেণিসংকট। একজন বাঙালি আরেকজন বাঙালিকে সামাজিক নিমন্ত্রণ যখন বিজাতীয় ভাষায় করেন তখন বোঝা যায় একটি বিশেষ শ্রেণিতে যে তাদের অবস্থান রয়েছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর এর চেয়ে বড় সুযোগ আর নেই। এসব মানসিক দৈন্যেরই প্রকাশ।
এ দেশে প্রচুর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটি নিম্নমানের, কোনোটি মধ্যম মানের, আবার কোনোটি মানসম্মত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি। নিম্ন ও মধ্যম মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে ভর্তি হতে না পারা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, এসব শিক্ষার্থীর অনেকেরই ভাষাজ্ঞানের ভিত্তি খুব দুর্বল। ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতা অনেক বেশি। তাই শিক্ষকদের ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা শুনে এবং ইংরেজি ভাষায় উত্তরপত্র লিখতে এদের ত্রাহি অবস্থা। অনেক শিক্ষক দুঃখ করে বলেন, এসব শিক্ষার্থীকে পাস করানো এবং মোটামুটি ভালো গ্রেডে পাস করানোর বাণিজ্যিক দায়িত্ব রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাই ভাষা-বানান না দেখে সে বিষয়বস্তুর মধ্যে আছে কি না তা দেখেই নম্বর দিতে হয়। অথচ এই শিক্ষার্থীই বাংলা মাধ্যমে পড়তে পারলে অনেক বেশি মেধাচর্চার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারত।
আজ বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর মানুষ মর্যাদার চোখে দেখলেও ভাষাযোদ্ধাদের উত্তরাধিকার এ সময়ের আমাদের অনেকের আচরণে বাংলা ভাষার প্রতি প্রকৃত সম্মানবোধ যেন নেই। ছোটবেলায় পবিত্র কোরআন শরিফ পড়ানোর সময় মৌলভি সাহেব বলতেন, সঠিক উচ্চারণ ও যথাযথ সুর-লয়ে কোরআন তিলওয়াত করতে হবে। না হলে গুনাহগার হতে হবে। ঠিক একইভাবে শিক্ষক ও শিক্ষিতজনের কাছে ইংরেজি লেখায় এক-আধটু বাক্যগঠন ও বানান ভুল ভয়ানক অন্যায় ও নিন্দার বলে পরিত্যাজ্য হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলা ভাষা প্রয়োগে কেমন ঢিলেঢালা ভাব। অনেকের মধ্যে আবার বাংলা শুদ্ধভাবে লিখতে বা বলতে না পারার মধ্যে এক অদ্ভুত অহংবোধ কাজ করে।
সড়ক-মহাসড়কের পাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দোকানের বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড পড়া আমার পুরনো অভ্যাস। এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে একটি বিশেষ কারণে। কারণ পথ চলতে দৈবাৎ বিস্মিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। যখন হঠাৎ চমকে উঠে দেখি গোটা সাইনবোর্ডটিই শুদ্ধ বানানে লেখা!
বাংলা সংবাদপত্রগুলোর একটি বিষয় আমাকে পীড়িত করে। পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁরা অনেক সময় ভাবতে চান না লাখ লাখ পাঠক পত্রিকার মাধ্যমে যেমন শিক্ষিত হতে পারেন, আবার বিভ্রান্তির আবর্তে তলিয়েও যেতে পারেন। এত দিনেও আমরা বোধ করি সর্বজনগ্রাহ্য একটি বানানরীতিতে পৌঁছতে পারিনি। বাংলা একাডেমি একটি প্রমিত বানানরীতি চালু করেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডেরও একটি বানানরীতি আছে। বাংলা একাডেমির বানানরীতির সঙ্গে এর মিল অনেকটাই। বাংলাদেশের বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থাগুলো এবং গ্রন্থপ্রণেতারা সাধারণত প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করে থাকেন। কিন্তু একটি অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে আমাদের সংবাদপত্রে ব্যবহৃত বানানরীতির ক্ষেত্রে। অনেক বাংলা সংবাদপত্র নিজেদের একটি বানানরীতি চালু রেখেছে। সেই রীতিতেই এরা শব্দবিন্যাস করে। ফলে পাঠক বাংলা বানান ব্যবহারে বিভ্রান্ত হন। আমাদের মনে হয়, বানানের ওপর এমন অতি স্বাধীনতা ভোগ না করাই উত্তম। টিভি চ্যানেলগুলোর বেশির ভাগের অনুষ্ঠান শুরু আর শেষে যে লেখাগুলো পর্দায় ভাসে বা স্ক্রলে সংবাদের শিরোনাম লেখা হয় তাতে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল বানানের ছড়াছড়ি থাকে। এসব চ্যানেলের কর্তৃপক্ষ একবারও ভাবে না তারা লাখ লাখ দর্শককে শিক্ষিত বা বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে। অথচ এদের এসব অজ্ঞতা প্রকাশের আনন্দ কেন তা আমার বোধগম্য নয়। এভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী মানসিকতা প্রতিদিন বাংলা ভাষাকে অসম্মান করছে।
শেষ করছি বছর পাঁচেক আগের একটি উদাহরণ দিয়ে। কারো কারো জন্য নতুন কথা নয়। আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। সে বছর আমি পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশ ভ্রমণ করেছি। আমি ফরাসি, স্প্যানিশ ও লাতিন ভাষা জানি না। ফলে পদে পদে বিপাকে পড়তে হয়েছে আমাকে। এসব দেশের বেশির ভাগ মানুষই ইংরেজি বলেন না। অনেকেই ইংরেজি চর্চার ধার ধারেন না। রাস্তার সাইনবোর্ড, বাসস্টেশন, রেলস্টেশন বা দোকানপাটে এবং দ্রব্যসামগ্রীর গায়ে ইংরেজি লেখা দৈবাৎ চোখে পড়ে। প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে লাখ লাখ বিদেশি পর্যটক গেলেও কোনো প্রদর্শিত বস্তুর গায়ে ইংরেজি লেখা নেই। ভাবখানা যদি জানতে চাও তো আমার ভাষা শিখে নাও।
গ্রিস আর রোম ছাড়া ইউরোপের বাকি অঞ্চলের সভ্যতা শূন্য থেকে বেড়ে ওঠে মধ্যযুগে। এর অনেক আগেই আমাদের সভ্যতা উচ্চাঙ্গে পৌঁছেছিল। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন আমাদের এগিয়ে চলার গতি থামিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপের দেশগুলো যখন নিজ ভাষা চর্চা করে উন্নতির উচ্চ শিখরে উঠতে পারছে তখন আমরা শিখছি নিজ ভাষা রসাতলে যাক, শুধু ইংরেজি ভাষাচর্চাই সব মুক্তির একমাত্র বটিকা।
ঐতিহ্যিক শক্তি ধারণ করে আধুনিক সময়ে বৈশ্বিকভাবে দেশ ও নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে ইংরেজি বা অন্য ভাষাকে বন্ধুর মতো পাশে রেখে-সাথি করে সবার আগে যে মাতৃভাষার চর্চা এগিয়ে রাখা দরকার এই বোধ স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মুক্তি নেই।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ ।
Leave a Reply