এম এস দোহা
পৃথিবী নিয়ন্ত্রণে অস্ত্র নয়, আগামীতে স্বাস্থ্য-ই থাকবে শীর্ষে। সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ২০৯ দেশের সরকার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে এটম বোমার চেয়ে করোনার কতটা ভয়াবহ। যার ছোবলে থেকে রক্ষা পায়নি বৃটেনের রাণী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গেদুচাচা। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ঝুকি মোকাবেলায় কোরারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন, লক আউট ও বাঙ্গালীর বাঁশের বেড়ায় অর্থনীতির বারোটা বাজাতে বাকী নেই।করোনায় আমাদের স্বাস্থ্যখাতের চিত্র ইতিমধ্যে উম্মোচিত। বহুল আলোচিত সাহেদের থলের বিড়াল বেরিয়ে গেছে। রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করেছে র্যাব। তমা গ্রুপ, জেএমআই গ্রুপ’র নীতিনির্ধারকরা এখন দুদুকের বারান্দায়। বহুল আলোচিত মিঠু গাডাকা দিয়েছে বিদেশে। স্বাস্থ্য সেক্টরের ১৮ ঠিকাদার কালোতালিকায়। ক্যাসিনো বিরোধী শুদ্ধি অভিযানের ন্যায় শুরু হলো স্বাস্থ্যখাতের ভাবমূর্তি রক্ষার ইতিবাচক কর্মসূচি।
এতোদিন আমরা চিকিৎসায় বিদেশ ও প্রাইভেট হাসপাতাল নির্ভর ছিলাম। তাই টের পাইনি। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সরকারী হাসপাতালের কোন বিকল্প নাথাকায় এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। করোনা এই যাত্রায় অনেক শিল্পপতি, রাজনীতিবীদ, আমলারা বেঁচে গেছেন। তারা এদেশে বাতাস আর লক্কর ঝক্কর চিকিৎসা সেবায় ধন্য। আগামীতে আমাদরে হাসপাতালগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে পৌছানোর দায়িত্ব এখন তাদের ঘাড়ে। বিদেশ নির্ভরতা নিরুৎসাহিত করে বাংলাদেশেই সকলের জন্য সাজাতে হবে মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বানিজ্যিকভাবেও লাভবানের রয়েছে সমূহ সম্ভবনা। এখন প্রয়োজন সঠিক কর্ম পরিকল্পনা। যা একান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ ও তত্বাবধানে ইতিবাচক ফলাফল সম্ভব।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিতে বিদেশে যায়। এ কারণে বছরে ৩৮হাজার কোটি টাকারও বেশি বাইরে চলে যায়। যা জিডিপির সাড়ে ৩শতাংশ। সিংহভাগই যায় ভারতে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে ভাবত ৮৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার আয় করে। তার মধ্যে বাংলাদেশি রোগীদের থেকেই এসেছে প্রায় ২ হাজার ৮শ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৩হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। বিদেশে চিকিৎসা করাতে আমাদের বছরে ২.০৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১দশমিক ৯৪ শতাংশ। প্রশ্ন হচ্ছে- স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের মাধ্যমে এই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা পাচাররোধ কি খুব অসম্ভব? করোনার কারণে চিকিৎসায় আমাদের বিদেশ নির্ভরতা এখন শূণ্যের কোটায়। একদিন হয়তো কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেমে যাবে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যখাত কি ভাইরাস মুক্ত ও উন্নয়ন প্রয়োজন নেই ?
স্বাধীনতাত্তোর বিগত ৫০ বছরের বাজেটে দেশের স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে যন্ত্রপাতির এই জীর্নশীর্ণ দৈন্যদশা কেন ? অবজ্ঞা আর অবহেলার মাধ্যমে এতোদিন আমরা সরকারী স্বাস্থ্যসেবাকে নিজেরাই গলাটিপে হত্যা করেছি।
স্বাস্থ্যখাতে বিগত দিনের বাজেট বরাদ্দে আমাদের উদাসীনতার প্রমাণ মিলে। ২০১৮ সালের ৭মে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনে এক জরিপে বলা হয়, জিডিপির হিসাবে জনস্বাস্থ্যে বাংলাদেশের বরাদ্দ দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে মতে, এ পরিমাণ জিডিপি’র এক শতাংশেরও কম। অথচ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো মধ্যে জিডিপির ১০.৮ শতাংশ মালদ্বীপ, আফগানিস্তান ২.৯, ভুটান ২.৬, নেপাল ২.৩, শ্রীলংকা ২, ভারত ১.৪, পাকিস্তান ০.৯ শতাংশ ব্যয় করে। অথচ বাংলাদেশের ব্যয় ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ০.৮ শতাংশ । করোনাকালীন ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে স্বাস্থ্যখাতের বাজেট বরাদ্দ আশানুরুপ বাড়েনি। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী এ খাতে বরাদ্দ প্রয়োজন জিডিপির ন্যূনতম ৫ শতাংশ। যা মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ।
কোভিড-১৯, নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় সমন্বয়হীনতা, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও হযবরল অবস্থায় স্বাস্থ্যখাত এখন ইতিহাসের কাঠগড়ায়। প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা, টেস্টিংয়ের আওতা বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা, হাসপাতাল প্রস্তুত করতে বিলম্ব, জনবল নিয়োগে দীর্ঘসুত্রীতা, সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, মাঠ প্রশাসন, সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত না করা। সুরক্ষা সামগ্রীর মান নিশ্চিতে ব্যর্থতা, চিকিৎসকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ঘাটতিসহ আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালের এখন হাবুডুবু খাচ্ছে জনগনের স্বাস্থ্য সেবা। করোনায় ইতিমধ্যেই হয়েছে ১০৫জন চিকিৎসকের মৃত্যু। আক্রান্ত প্রায় ২ হাজার। নার্স, টেকনোলজিষ্ট সহ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার। এধারা অব্যাহত থাকলে সামনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।
কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নেতৃত্ব দেওয়া উচিত ছিল নিপসম (ঘওচঝঙগ) এর। এটা আইইডিসিআর এর কাজ না। তাদের কাজ গবেষণা। দেশে ৪৯৭টি উপজেলা হাসপাতাল, ১২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, জেলা সদর হাসপাতাল ও অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল। ৭০হাজার প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও পাঁচ লাখের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী আছে। এগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য দরকার ছিল ত্বরিত পদক্ষেপ, দক্ষতা ও সমন্বয় সাধন।
প্রাইভেট হাসপাতালগুলো দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিলেও এই সংকটে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে ভিলেনের কাতারে। নায়কের ভূমিকায় মন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সিলেটের ডাঃ মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর পর আমরা নতুনভাবে পরিচিত হলাম করোনা চিকিৎসায় সক্ষমতা ও দৌঁড় সম্পর্কে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে ২ লাখ বেড খালি পড়ে আছে। অথচ আমরা নতুন হাসপাতাল তৈরীতে সময় ও অর্থ ব্যায় করে যাচ্ছি। এ সেক্টরে ২লক্ষ প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিষ্টকে কাজে লাগাতে পারছিনা। অথচ চিকিৎসা ও পরীক্ষার জন্য চলছে হাহাকার। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, খোদ পিজি হাসপাতালের ১৫০০ ডাক্তার বেকার। কোন রোগী আসছেনা তাদের কাছে। যারা আসছেন তাদের করোনা সার্টিফিকেট নাই। ২৫০০ বেড খালি। রোগী নাই। অথচ চিকিৎসার জন্য মানুষের নীরব কান্না চলছে। শত চেষ্টা করেও রোগীরা ডাক্তারদের সাক্ষাৎ পাচ্ছে না। বলা হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার। এনিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনার পর প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ৫জুলাই ৩৭০ শয্যার করোনা স্বাস্থ্যসেবা চালু করে হাসপাতালটি। এটা দেরীতে হলেও শুভ সংবাদ।
উল্লেখ্য, ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী মারা যায়। ৮ মার্চ পর্যন্ত ১২৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। আর এখন ১৭/১৮ হাজার পরীক্ষা করা হচ্ছে। আগে আইইডিসিআর একা পরীক্ষা করত। এখন ৬২টি ল্যাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রথম মৃত্যুর সাড়ে তিন মাস পর এখন দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই বেড়েই যাচ্ছে। কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রধানমন্ত্রী ত্বরিত নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়নে বড় বাধা হচ্ছে অদক্ষ, অযোগ্য ও অথর্ব কর্মকর্তারা। এটা কি অদক্ষতা, নাকি শেখ হাসিনার সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলার চক্রান্ত ?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করোনাকালীন সময়ে এখন পদ্মাসেতু, মেট্টোরেল মেঘা প্রকল্পের পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে দাবী উঠেছে। গত ৩০জুন সংসদে বাজেটের সমাপনী অধিবেশেনে সরকার ও বিরোধীদলের সদস্যগণ এ দাবী জানান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের মধ্যে সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-দুর্নীতি অভিযোগ র্দীঘদিনের। জাতীয় সংসদে এ নিয়ে আলোচনার পর বিষটি ভিত্তি আরো মজবুত হলো। মন্ত্রী, এমপি, আমলাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টিও সংসদের কার্যপনালী বিধিতে হয়েছে অর্ন্তভূক্ত। প্রধানমন্ত্রী মনযোগ সহকারে এসব বক্তব্য, দিকনির্দেশনা, প্রস্তাবনা শুনেছেন। হয়তো এর একটা সুফল জাতি অচিরেই পাবে।
লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক নতুন সময়।
Leave a Reply