সৃষ্টির পর থেকে ধাপে ধাপে বদলে গেছে পৃথিবী। পুরনো বৃত্ত ভেঙে সূচিত হয়েছে পরিবর্তন আর সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। আবার ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীর বড় বড় বেশকিছু পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে এক বা একাধিক ভাষণ, কারণ বিশ্বে বিশেষ ক্ষেত্রে এমন ভাষণ কিংবা ভাষণে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন হয়ে ওঠে এক একটি মারণাস্ত্র কিংবা শক্তিশালী বোমার চেয়েও শক্তিধর কিংবা ভয়ঙ্কর। তাই এ ভাষণগুলোই পেরেছে ইতিহাসের গতি পাল্টে দিতে। পৃথিবীর অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা, রাষ্ট্রনায়ক ও সামরিক জান্তা এমন কিছু ভাষণ দিয়েছেন যা তাদের ইতিহাসের অংশে পরিণত করেছে। আবার এমন কিছু ভাষণ আছে যা মানুষকে জীবন বিলিয়ে অধিকার আদায়ে উজ্জীবিত করেছে। ফলে পরিবর্তিত হয়েছে ইতিহাসের গতিধারা। জন্ম দিয়েছে নতুন দল, নতুন সমাজ, নতুন দেশ এমনকি নতুন জাতিসত্তা।এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭১
মাত্র ১০ দিন পর শুরু হবে জাতির জনক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকীর আনন্দযজ্ঞ। আর আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের পাশাপাশি একটি ঐতিহাসিক ভাষণেরও সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে। ১৯৭১ সালের এ দিনে (৭ মার্চ) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) মুক্তিকামী লাখো বাঙালি আর দেশ-বিদেশের শতাধিক গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতিতে এক অভূতপূর্ব ভাষণ দেন। মাত্র ১৮ মিনিটের এ ভাষণ কোনো কাগজ বা নোটের সাহায্য ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারণ করেন জাতির পিতা। শব্দের বুনন, প্রাণের আবেগ আর দরাজ গলায় বর্ষিত এ ভাষণ যেন বুলেটের মতো বুকে প্রবেশ করে উজ্জীবিত করে সমগ্র বাঙালি জাতিকে। আর রকেট শেলের মতো বিদীর্ণ করে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকদের হৃৎপিন্ড। কী ছিল না এই ভাষণে! ইতিহাসবেত্তার মতো বঞ্চনার ইতিহাস, মনস্তাত্ত্বিকের মতো স্বজন হারানোদের প্রতি সমবেদনা, দক্ষ প্রশাসকের মতো প্রশাসন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা, সর্বোপরি দক্ষ সেনানায়কের মতো যুদ্ধের কৌশলÑ একে একে সবই বলে গেছেন স্বাধীনতার এই রূপকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে বারবার তার জীবনে নেমে এসেছে জেল, জুলুম আর হুমকি। এরই মাঝে অতি সাধারণ এক বাঙালি পরিবার আর প্রিয়তমা স্ত্রী ফজিলাতুননেছা ছিলেন তার অনুপ্রেরণার উৎস। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এ ভাষণ শোনার জন্য উন্মুখ হয়েছিল গোটা জাতি। তার সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎ মতে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বেশ বিচলিত। ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, ৩ মার্চ পূর্ব নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন ভেঙে দেওয়া, দেশব্যাপী চলমান অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল, জেলায় জেলায় হত্যাকা-, জনগণের প্রত্যাশা, সামরিক জান্তার জীবননাশ ও দেশদ্রোহিতার মামলার হুমকিÑ সব মিলিয়ে জীবনের এক কঠিন দিন পার করছিলেন জাতির জনক। এদিকে লাখো জনতা সকাল থেকেই মাতিয়ে তুলেছে রেসকোর্স ময়দান। কী করবেন বঙ্গবন্ধুÑ কী বলবেন এ নিয়ে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। এদিন দুপুরে ভাত খেয়ে বিছানায় গেলেন বঙ্গবন্ধু সামান্য বিশ্রামের জন্য। প্রিয়তমা স্ত্রী, যাকে তিনি রেনু বলে ডাকতেন, পাশে বসলেন নিজের পানের বাটা নিয়ে। সহজ-সরল এই গৃহবধূ নিজ স্বার্থ, সন্তানের ভবিষ্যৎ, পরিবারের নিরাপত্তাÑ এসব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ভাবলেন দেশের কথা। বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাউকে ভয় করবে না। দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার যা বলা উচিত তা-ই বলবে, নিঃসংকোচে বলবে, নির্ভয়ে বলবে। সঞ্জীবনী সুধার মতো কাজ করল আজ বঙ্গমাতা উপাধি পাওয়া এই মহীয়সী নারীর অনুপ্রেরণা। চিরাচরিত রীতিতে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধু। রেসকোর্স ময়দান তখন লাখো মানুষের এক জনসমুদ্র। চারদিকে গগনবিদারী স্লোগান। মঞ্চে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকের বর্ণনামতে, স্লোগান-মুখরিত মঞ্চে বঙ্গবন্ধু সামনে এগিয়ে গেলেন। বললেন, ‘মাইকটা দে।’ তারপর শুরু করলেন তার কিংবদন্তিতুল্য ভাষণ। প্রথমে তুলে ধরলেন তার দুঃখভরা হৃদয়ের কথা। কারণ দেশের বিভিন্ন শহরের রাজপথ তখন রক্তে রঞ্জিত; বাতাসে বারুদ আর লাশের গন্ধ। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল স্বাধীনতা, বেঁচে থাকা আর অধিকার আদায়ের করুণ আর্তনাদ। একে একে তুলে ধরলেন তার দেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রস্তাব, যাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। ’৫২ থেকে একে একে প্রায় প্রতিটি বছরে যে রক্তপাত ঘটেছে তারও বর্ণনা দিলেন। এ বর্ণনা থেকে বাদ যায়নি ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের কথাও। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, তিনি চান জনগণের অধিকার। এ অধিকার আদায়ে তিনি হরতাল ও সর্বগ্রাহী আন্দোলনের ডাক দেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন এবং তার অবর্তমানেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আর সবশেষে তার অগ্নিঝরা কণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ মন্ত্রের মতো কাজ করে তার এই ঘোষণা। অচল হয়ে পড়ে সারা দেশ। শুরু হয় প্রতিরোধ। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ জীবন, লাখো নারীর সম্ভ্রম আর দেশের অমূল্য সম্পদের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু বন্দী থাকলেও তার ৭ মার্চের ভাষণ যেন প্রতিদিন বাজত মুক্তিযোদ্ধাদের কানে। তাই বঙ্গবন্ধু আজও জাগ্রত, শাশ্বত এবং চিরন্তন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। জাতিসংঘের অন্যতম অঙ্গসংগঠন ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন’ (ইউনেস্কো) বাংলা ভাষায় প্রদত্ত জাতির জনকের ৭ মার্চ ১৯৭১-এর ভাষণ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’ এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। এভাবে একটি দেশের স্বাধীনতার নেপথ্য শক্তি থেকে বিশ্বসম্পদে পরিণত হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। কারণ এক কথায় বলতে গেলে একটি ভাষণ কীভাবে কোটি কোটি মানুষকে জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিতে পারে তার উদাহরণ ৭ মার্চের ভাষণ। ইতিহাসে বাংলাদেশ নামের একটি নতুন দেশের জন্ম। তাই ভাষণের কাছে ঋণী।’
Leave a Reply