1. mti.robin8@gmail.com : Touhidul islam Robin : Touhidul islam Robin
  2. newsnakshibarta24@gmail.com : Mozammel Alam : Mozammel Alam
  3. nakshibartanews24@gmail.com : nakshibarta24 :
শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন
১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিজয় মনন ও অসাম্প্রদায়িকতা

  • প্রকাশকালঃ বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০
  • ৩৮৭ জন পড়েছেন

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী  :


এটি সর্বজনবিদিত যে, দীর্ঘ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার সন্দীপ্ত লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ নির্মাণ।

বিশ্ব ইতিহাসের স্বাধীনতা প্রাপ্তির অধ্যায়ে এত বেশি প্রাণ বিসর্জনের উদাহরণও বিরল। বিজয় মাসের গৌরবগাথা বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের জন্য এক ক্ষুভিত আনন্দ ও অন্তর্দাহের অনুরণন। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হলেও বীরত্বের এ অনুস্যূত অনুধাবন কোনোভাবেই অবজ্ঞা-অবমূল্যায়ন করা যাবে না।

যথার্থ ইতিহাস চর্চা এবং আগামী দিনে রাজনীতি-রাষ্ট্র শাসনের জন্য মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ, দেশপ্রেমিক নাগরিক প্রস্তুতকরণে বাঙালির দেশ-জয়ের নিখাদ সত্যের কাঠিন্য প্রকাশ অনিবার্য। জাতীয় কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির, কাপুরুষ ভয়ে কাঁপে লড়ে যাবে বীর।’ বীরের জাতিতে ভূষিত বাঙালি কখনও পরাভূত হওয়ার নয়।

বাংলাদেশের জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, সব অসৎ-অশুভ পরাজিত অন্ধকারের অপশক্তিকে নিধন করে এ জাতি পরিপূর্ণ প্রগতির গন্তব্যে এগিয়ে যাবেই।

কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘সাবাস বাংলাদেশ এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ দুঃখজনক হলেও সত্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনশ্বর চেতনা জাতির সংসিদ্ধ মননে কতটুকু সার্থক ও কার্যকর, তার অর্থবহ বিশ্লেষণ এখনও তদর্থ প্রয়োজন। মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের বেতার ও টেলিভিশন ভাষণের নির্যাস স্মরণ করা অপরিহার্য। তিনি বলেছিলেন, ‘ষোলই ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় দিবস। আরও স্পষ্ট কথা বিজয় দিবস।

লাখো শহীদের রক্তমাখা এই দিন। লাখো মা-বোনের অশ্রুভেজা এই দিন। আবার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্ন ও পরম আকাক্সক্ষার এই দিন। এদিন আমরা পরাধীনতার শিকল ভেঙে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।’

উল্লেখ্য, দৃঢ়চেতা ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সোনার বাংলার মানুষ বিদেশি শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে। এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে বড় পবিত্র, বড় বেশি গৌরব ও আবেগমণ্ডিত। এই দিন আমরা শ্রদ্ধা ও শোকের সঙ্গে স্মরণ করি আমাদের শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, আবার এই দিন আমরা আনন্দ উৎসব করি, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্যের জন্য। এই দিন এক যুদ্ধ শেষ আরেক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। উনিশশ’ একাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি। এই একই দিনে আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু। স্বাধীনতা সংগ্রামের চেয়েও দেশ গড়া বেশি কঠিন। দেশ গড়ার সংগ্রামে আরও বেশি আত্মত্যাগ, আরও বেশি ধৈর্য, আরও বেশি পরিশ্রম দরকার।’

শোষণ-বঞ্চনা, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের স্বৈরাচারী মনোভাব, সাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাদমুখিতা, পরনির্ভরশীলতাকে সংহার করে মনুষ্যত্ব ও মানবতাকে যথাযথ ধারণ-লালনে জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা প্রতিপালন এখনও বহুলাংশে অসম্পূর্ণ।

অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, অবৈধ ও অনৈতিক পন্থায় অর্থ ও পেশিশক্তির কদর্য দুর্বৃত্তায়ন কীভাবে দেশকে প্রচণ্ড পর্যুদস্ত করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে, তা প্রতিনিয়ত আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। সাম্প্রতিককালে ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)’ ঠেকাতে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন করা হবে, হিন্দু-মুসলমান বিভাজন বাংলায় করতে দেব না।

সব ধর্মের লোক এখানে বাস করবেন’ মর্মে প্রদত্ত সত্যবাদী বক্তব্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প বাঙালি সমাজকে যে কুৎসিত আক্রান্তে এখনও ক্ষত-বিক্ষত করছে; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা থেকে তা সহজেই অনুমেয়।

মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মহামনীষীদের জীবনচরিত ও আদর্শ-চলৎশক্তির পরিচর্যা-অনুকরণ ও অনুশীলন সমধিক প্রণিধানযোগ্য। বিঘোষিত উঁচুমার্গের এসব কীর্তিগাথা যথার্থ অর্থে প্রোথিত করা না হলে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে নষ্ট চরিত্রের অবস্থানে আমাদের নির্বাসিত করা হবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটিই বাস্তবতা।

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) সম্পর্কে খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ উইলিয়াম মুর বলেছিলেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) যে যুগে এ ধরিত্রীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি শুধু সেই যুগেরই মনীষী নন; বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামনীষী। সমাজের সামগ্রিক অসঙ্গতি, শোষণ, অবিচার, ব্যভিচার, সুদ-ঘুষসহ অপরাধমুক্ত সবার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণকর সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তিনি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ ও পবিত্র আরাফাত ময়দানে প্রায় এক লাখ চৌদ্দ হাজার সাহাবির সম্মুখে বিদায় হজখ্যাত ভাষণের শুরুতেই সম্বোধন করেছিলেন ‘হে বিশ্ব মানবকুল’ অর্থাৎ কোনো বিশেষ সম্প্রদায়, জাতি-রাষ্ট্র বা ধর্ম-বর্ণ নয়, মহান স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা সমগ্র মানব সমাজের উদ্দেশ্যেই তার এ ভাষণ ছিল বিশ্বশ্রেষ্ঠ মানবাধিকার সনদ।

পবিত্র কোরআনে মহান স্রষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন- তিনি কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে বিশেষ রহমতস্বরূপ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন।

এ সনদে দীপ্তকণ্ঠে ঘোষিত ছিল, ‘কখনও অন্যের ওপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না, স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তোমাদের ওপরও স্ত্রীদের তেমন অধিকার আছে, যে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে, সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না, চাকর-চাকরাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর হইও না, তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তা-ই খেতে দেবে; তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরকে তা-ই (সমমূল্যের) পরিধান করতে দেবে, কোনো অবস্থাতেই এতিমের (পিতৃ-মাতৃহীন মানব) সম্পদ আত্মসাৎ করবে না।’

প্রিয় নবীর এ মহামূল্যবান অমিয় ভাষণ বিশ্বের সব ধর্ম-বর্ণ-দলমত-অঞ্চল-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার কাছে পরম গ্রহণযোগ্য প্রেষণা ও অনুপ্রেরণা। মনীষী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, শ্রীচৈতন্যসহ জীবনের সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-আনন্দ অনুসন্ধানে যারা নিরন্তর মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষায় রাজবর্ত্ম উত্তীর্ণ, ধর্মের বিভেদ-বিচ্ছেদে চরম পীড়িত ছিলেন তারা।

ধর্মের সঙ্গে ধর্মের, বর্ণের সঙ্গে বর্ণের, উঁচু ও নচু বর্ণের মধ্যকার বৈষম্য, ধনী-দরিদ্রের বিভাজন ও নিপীড়ন দূরীকরণে তাদের অবদান ছিল অপরিসীম।

১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু জাতির আদর্শ হিসেবে পবিত্র সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভ অসাম্প্রদাায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে।

খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল-বদর পয়দা করা বাংলার বুকে চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।’

‘জাতির পাঁতি’ কবিতায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কী অসাধারণ পঙ্ক্তিতে উচ্চারণ করেছেন, ‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি; … দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙা, কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা।’

মানুষকে মানবিক সমাজের বিশ্ব নাগরিকতা প্রদানের লক্ষ্যে ‘হিন্দু-মুসলমান’ নিবন্ধে কবি নজরুল বলেছেন, ‘অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তারা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি- আলোর মতো, সকলের জন্য।’

কোনো ধার্মিক অসাম্প্রদায়িক মানবিক ব্যক্তি কখনও বলতে পারেন না, আমি একজন হিন্দু বা একজন মুসলমানকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছি। তার সাবলীল কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি- আমারই মতো একজন মানুষকে।’

আলোকিত মুজিববর্ষে করোনা মহামারীর দুঃসময়ে অনাড়ম্বর বিজয় দিবস উদযাপনে তথা বিজয় মনন ২০২০ বা অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সর্বজনীন ব্রতে জাতির ঐক্যবদ্ধতার নবতর অবগাহনে ভাস্বর হয়ে উঠি- এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করে নিবন্ধের ইতি টানছি।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

খবরটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো খবর

বিজ্ঞাপন

Laksam Online Shop

first online shop in Laksam

© All rights reserved ©nakshibarta24.com
কারিগরি সহায়তায় বিডি আইটি হোম